বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫১ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
আজীবন সম্মাননা পেলেন জনাব ওসমান গণি ও শফিকুর রহমান মধু মিয়া বৃষ্টির ধারায় মুছে যাক “রোজা রাখি, আল্লাহর হুকুম পালন করি, নিজে সুস্থ থাকি অপরকে সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করি” মঙ্গলকাটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার ‘MCTC’র এক যুগ পূর্তিতে আনন্দ ভ্রমণ ফেনিবিল ও কোনাপাড়া সমাজকল্যাণ যুব সংঘের অমর একুশে উদযাপন ‘আব্দুল গণি ফাউন্ডেশন’ মেধাবৃত্তি পরিক্ষা-২২ এর বৃত্তি প্রাপ্তদের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত নারায়ণতলা মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত সুনামগঞ্জের ডলুরা বর্ডারহাটে অনিয়ম ও মাদক বন্ধের দাবীতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত তৃতীয় বারের মত অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো দাখিল ২০০৪ ব্যাচ এর মিলনমেলা কোনাপাড়া সমাজকল্যাণ যুব সংঘের শীত বস্ত্র বিতরণ

আমার দেখা আধুনিক তুরস্ক

আমার দেখা আধুনিক তুরস্ক

ড. এম এ আজীজ: 

দীর্ঘ ৩৪ বছর আগে ১৯৮৪ সালে সৌদি আরব যাওয়ার পথে স্বল্প সময়ের জন্য তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যাত্রাবিরতিতে একটু দেখার সুযোগ হয়েছে। তাতে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তখনো তুরস্ক ও ওই দেশের মুসলিমদের সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা আমার ছিল না। তারও আগের ঘটনা। ব্রিটেনে ১৯৭৬ সালে আসার পর একদিন ইস্ট লন্ডন মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে যাই। তখন ইস্ট লন্ডন মসজিদ আজকের মতো ইউরোপের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ছিল না। এখন প্রায় এক সাথে ২০ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন।

বর্তমান জায়গায় তখন ত্রিপলের ছাদ ছিল। চার দিকে অস্থায়ী ঘেরাও ছিল। কোনো বিল্ডিং ছিল না। মসজিদের বাইরে দেখতে পেলাম, একদল মহিলা কান্নাকাটি করছেন। অবাক হলাম, পরনে স্কার্ট ও মাথায় ববকাট চুল, কোনো স্কার্ফ বা মাথার কভার নেই। অনেক পুরুষও ছিলেন। দেখতে ও পোশাকে একেবারে ইংরেজ। এ দেশের শ্বেতাঙ্গ ও তাদের মধ্যে রঙ ও চেহারায় কোনো পার্থক্য নেই। তবে মসজিদের সামনে কেন কাঁদছেন?

তখনো বিশ্ব মুসলিমদের ব্যাপারে আমার পর্যাপ্ত ধারণা ছিল না। সবে বাংলাদেশ ছেড়ে লন্ডনে আসা। এক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম তারা কারা? কেন কাঁদেন? বললেন, ‘এরা হলেন তুরস্কের মুসলিম। তাদের কোনো এক আত্মীয় মারা গেছেন। তার এখানে জানাজা হয়েছে, তাই কাঁদছেন।’ জানা দরকার তখনকার দিনে সম্ভবত পুরো ব্রিটেনে একমাত্র মরহুম হাজী তাসলিম আলীই মুসলমানদের লাশ কালেকশন, গোসল দেয়া, জানাজা, কবরের ব্যবস্থা করা ও প্রয়োজনে মৃতদেহ নিজ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।

তুর্কি মুসলমানদের এ অবস্থা দেখে সত্যিই অবাক হলাম। তার কিছু দিন পর টার্কিশ এয়ারলাইনে ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে ইস্তাম্বুল হয়ে রওনা দিলাম। এয়ারলাইন যাত্রীদের যে হোটেলে রেখেছিল, তাতে যা দেখলাম; বলার মতো নয়। স্থানীয় লোকেরাও খেতে ও আনন্দ করতে এসেছে। তাদের আনন্দ-ফুর্তির অবস্থা আরো ভয়ানক যা তখনকার বাংলাদেশী মুসলমানের চিন্তারও বাইরে। রেস্টুরেন্টের ডাইনিং রুমে মদ, নাচ-গান সবই চলছে। গান ও নাচের জন্য ডাইনিং রুমে স্টেজ রয়েছে। গানের সাথে সাথে স্টেজে যুগল নাচ। কোনো যুগল নামে আবার অন্যরা ওঠে। এভাবে চলছিল। এটা তখনকার দিনে আমাদের বাংলাদেশে দেখিনি, খুব একটা শুনিওনি। কতই না আজব!

যে তুর্কি খেলাফত, ইসলামি ভাবধারায় শত শত বছর পুরো আরব জগৎ (সৌদি আরব মক্কা ও মদিনাসহ, জর্দান, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, ইয়েমেন প্রভৃতি) আফ্রিকার মিসর, সুদান, ইরিত্রিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, ইউরোপের গ্রিস, সাইপ্রাস, ক্রিমিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, কসোভো, আলবেনিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনাসহ বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল; আজ সব হারিয়ে তাদের দেশের মুসলমানদের এই করুণ দশা।

পশ্চিমের শোষকেরা মুসলমানের রাজত্বকে ধ্বংস করার সাথে সাথে নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আচার-আচরণ থেকেও তাদের অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। হয়তো কোনো দেশে বেশি এবং কোনো দেশে কম। আর তাই মুসলিম দেশগুলোতে আজ ইসলাম এবং পশ্চিমাদের রেখে যাওয়া আচার-আচরণের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায় একদল আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মোল্লা (যারা বর্তমান দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তেমন কোনো খবর রাখেন না। আরেক দল পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের ধর্মের ব্যাপারে তেমন কোনো জ্ঞান রাখে না) ‘গোল্লা’য় পরিণত হয়েছে। তাই তিনি ‘মোল্লা ও তরুণ’ প্রবন্ধে একই দেশে ও পরিবারে দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বের অবস্থা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন।

সাম্রাজ্য হারা, ধর্মহারা ও ‘আধুনিক’ সভ্যতায় অভ্যস্ত তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুল। মাদরাসাপড়–য়া এক যুবক যে ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসী, ছোটবেলায় অলিগলিতে সেমিট রুটি, মেলন ও লেমন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছিল। আজ পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী ও শক্তিশালী তুরস্কের একাধারে ১৬-১৭ বছর শাসনকারী অত্যন্ত প্রতাপশালী শাসক তিনি। একই সাথে গণতন্ত্রকামী ও অত্যন্ত সফল, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের আধুনিক তুরস্ক সম্পর্কে অনেক কিছু শুনছি ও পড়াশোনা করছি। তাই পরিবর্তিত তুরস্ক দেখার জন্য মন সব সময় অধীর হয়ে আছে।

‘প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও তার পার্টির সফলতা এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে ইসলামী নেতাদের বা আমাদের শিক্ষণীয়’ বিষয়ে কিছু লেখা লিখছি। তাই সংশ্লিষ্ট দেশকে স্বচক্ষে দেখার ও জানার জন্য লেখাগুলো প্রকাশ করার আগে বর্তমানে দেশটি সফর করা উচিত মনে করছিলাম। তাই আমার এবারের তুরস্ক সফর।

এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো- কয়েক বছর আগে প্রেসিডেন্ট এরদোগান যখন লন্ডনে তার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সফরে এসেছিলেন, তখন মরহুম ব্যারিস্টার আজহার আলীর মাধ্যমে তার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। তারপর আমরা দু’জনে একসাথে তুরস্কে যাবো বা কোনো একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করব, এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তিনি আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করায় তা হয়ে উঠল না। ইতোমধ্যে আমাদের কয়েকজন বাংলাদেশী ভাই লন্ডন থেকে তুরস্কে গিয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণ করায় আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত এর ব্যবস্থা হলো। শুধু ‘হলিডে’ করার জন্য যেকোনো সময় যাওয়া যায়, তাতে কিছু স্মরণীয় স্থান দেখা আর ফটো তোলা ছাড়া বেশি কিছু জানা যায় না। আমার অনেক কিছু জানার ইচ্ছা। তাই বর্তমান ক্ষমতাসীন শাসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কিভাবে দেখা করা যায়, সেজন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু করলাম। ভাইতুল্য হাসান বাসরি ও হাকান এরদেমের মাধ্যমে আল্লাহ পাক সেই ব্যবস্থা করে দিলেন।

উল্লেখ্য যদিও তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা; কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুল। আট কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৫০ লাখই ইস্তাম্বুলে বাস করেন। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর বেশির ভাগ ওই শহরেই অবস্থিত। ইস্তাম্বুল ব্যবসায়-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ও শিক্ষা-সেমিনারের কেন্দ্র। এমনকি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের রাজনৈতিক পার্টি আদালত ভে কালকিনমার অর্থাৎ ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন, সংক্ষেপে একে পার্টির হেড অফিস ও কেন্দ্রীয় অফিসগুলোও ইস্তাম্বুলেই অবস্থিত। এই ইস্তাম্বুল থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উত্থান, যে শহরে জীবিকার জন্য এক সময় তিনি ফেরি করেছিলেন।

নেতাদের সাথে যোগাযোগ হলো। তারপর ২২ অক্টোবর লন্ডন থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রওনা হলাম। বেশ কিছু নেতার সাথে দেখা হলো। অনেক কিছু জানতে চাইলাম, উত্তরও পেলাম। লেখার জন্য লিখিত উত্তর চাইলাম। তারা বললেন, তৈরি করে যথাসময়ে পাঠিয়ে দেবেন। ইতোমধ্যে পাঠিয়েও দিয়েছেন। যে বিষয়গুলো আমি দেখার ও বোঝার চেষ্টা করেছি তা সংক্ষেপে বর্ণনা করব।

কামাল আতাতুর্ক এয়ারপোর্ট : এয়ারপোর্টে নেমেই হাজার হাজার লোক দেখে কিছুটা চিন্তিত হলাম। কখন যে বের হতে পারব আল্লাহ তায়ালাই জানেন। কারণ, নিজের ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও লন্ডনে স্টানস্টেড এয়ারপোর্ট ও মাঝে মধ্যে হিথ্রো এয়ারপোর্টেও এত বেশি সময় লাগে, যাতে পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে স্টানস্টেড ও আমেরিকার কেনেডি এয়ারপোর্টে একাধিকবার এ অবস্থা হয়েছে। একাধিকবার স্টানস্টেড এয়ারপোর্টে প্রায় তিন ঘণ্টা লেগেছিল। যা হোক, ইস্তাম্বুলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে হাজির হলাম। পাসপোর্ট চেক করে বললেন, ভিসা নেই। তিনি ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিলেন; ভিসা কাউন্টার। মাথায় যেন বাড়ি পড়ল; কখন ভিসা নেব, আবার কখন এত বড় লাইন ধরে কাউন্টারে আসব। আগে থেকেই জানি, ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকলে ভিসা লাগে না।

এর মানে হলো, পোর্ট এন্ট্রি ভিসা অর্থাৎ এয়ারপোর্টে গেলেই স্টাম্প দিয়ে ভেতরে যেতে দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে এয়ারপোর্টে অথবা অনলাইনে ভিসা নিতে হয়- এ কথাটি কেউই বলেনি। নতুবা অনলাইনে তা নিয়েই রওনা হতাম অথবা এয়ারপোর্টে নেমেই ভিসা নিয়ে তারপর কাউন্টারে যেতাম। প্রায় ৩৫ বছর আগে যখন গিয়েছিলাম, তখন কোনো ভিসারই দরকার ছিল না। জীবনে এই প্রথম খোঁজখবর না নিয়ে আমার শিক্ষা হলো। ভিসা কাউন্টারে গেলাম, অবাক হওয়ার মতো কাণ্ড, এক মিনিটেই ২০ পাউন্ডে একটা রেডি স্টিকার লাগিয়ে দিলো।

দৌড়ে লাইনে এসে দেখি অবাক কাণ্ড, এত লোক কোথায় ‘গায়েব’ হয়ে গেল? তার মানে তুর্কিরা বুঝে, শুধু কাজ আর কাজ। অসংখ্য কাউন্টার খুলে রাখা হয়েছে। কোনো টুরিস্টের যেন কোনো কষ্ট না হয় তারা সে ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। এসব কারণেই এ বছর শুধু গত ৯ মাসেই ৩৫ মিলিয়ন তথা তিন কোটি ৫০ লাখ টুরিস্ট তুরস্কে হলিডে করতে গেছেন। এ বছর মোট চার কোটি টুরিস্ট আসবেন বলে ধারণা। এয়ারপোর্টের সার্ভিসের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই। পত্রিকার খবরে দেখা গেছে, এ বছর একজন ট্যাক্সিড্রাইভার একজন টুরিস্টকে অতিরিক্ত চার্জ করার কারণে পাঁচ বছর জেলের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এ হচ্ছে এয়ারপোর্ট ও হাজার হাজার ট্যাক্সি-সার্ভিসের সুব্যবস্থা। নিরাপদে সবাই এয়ারপোর্ট থেকে নিজ নিজ হোটেলে যেতে পারছেন। এয়ারপোর্টের ভেতরেই ট্যাক্সির অনেকগুলো অফিস আছে। আগেই ভাড়া নির্ধারণ করে নিতে পারেন। প্রয়োজনে দরাদরি করতে পারেন, তাতে সামান্য সস্তায় যাতায়াত করতে পারবেন।

কিছু দিন আগেও ইউরোপিয়ান দেশগুলো বলত, তুরস্ক ইউরোপের একটি ‘রুগ্ণ’ দেশ। এ পশ্চিমা দেশগুলো এক হয়ে তুরস্কের খেলাফত ও বিশাল সাম্রাজ্য শেষ করে সবাই মিলে ছলে-বলে-কৌশলে পাশ্চাত্যপন্থী সরকার দিয়ে আট কোটি মুসলিমের এ দেশকে ৮০ বছর গরিব করে রেখেছিল।

এ পর্যন্ত পুরো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বহু দেশ সফর করার সুযোগ আমার হয়েছে। যেকোনো দেশে যাওয়ার পর আমি লোকজনের আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক দেখে ওই দেশের লোকজনের সচ্ছলতা সম্পর্কে অনুমান করার চেষ্টা করি। তারপর রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ কেমন এবং গাড়ির মডেল ও অবস্থা দেখেও সে দেশের আর্থিক উন্নতির মাত্রা নির্ণয় করার চেষ্টা করি।

সরকারি হিসাব মতে, তুরস্কে মাথাপিছু আয় বর্তমান সরকারের আগ পর্যন্ত ৮০ বছরে পৌঁছেছিল বার্ষিক তিন হাজার মার্কিন ডলারে। আর একেপির ১৫ বছরের শাসনামলে মাথাপিছু বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ডলার। ২০২৩ সালের মধ্যে সরকারের টার্গেট এটি ২৫ হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত করা। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে পুরো শহর, বন্দর, মাজার ও মসজিদে কোথাও একজন দেশী-বিদেশী ভিক্ষুক চোখে পড়েনি। এমনকি কোনো বস্তিও নজরে পড়েনি। অথচ লন্ডনের মতো চরম উন্নতির নগরেও আজকাল বহু দেশী-বিদেশী ভিক্ষুক নজরে পড়ে। পৃথিবীর সেরা ধনী দেশের নিউ ইয়র্কেও অনেকবার দেখেছি, ছিন্নমূল মানুষ আবর্জনার ডাস্টবিন থেকে খাবার উঠিয়ে খাচ্ছে।

বোঝা যায়, কিভাবে তুরস্ক এরদোগান ও তার পার্টির শাসনে অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুর্কিরা পোশাক-পরিচ্ছদে উন্নত দেশের চেয়ে কোনো দিক থেকে কম নয়। প্রত্যেক তুরস্কবাসীর হাতে ভালো স্মার্ট ফোন; কারো হাতেই অর্ডিনারি ফোন চোখে পড়েনি। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা, উন্নত ব্র্যান্ডের মডেল ও চাকচিক্যের দিক থেকে বলা যাবে না, তুরস্ক ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে কোনো দিকে পিছিয়ে আছে। বরং কোনো কোনো উন্নত মডেল যথা মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ আমদানি করে নিজস্ব রুচিমতো আরো উন্নত করেছে; যা ব্রিটেন-আমেরিকার মতো দেশেও সাধারণত দেখা যায় না।

ইস্তাম্বুলের রাস্তাঘাট প্রচুর। পেভমেন্ট ছাড়া রাস্তার অবস্থা ও ট্রাফিক সিস্টেমও অনেক উন্নত। ইস্তাম্বুলবাসীর সাথে যোগ হয়েছে সিরিয়া ও অন্যান্য দেশের গৃহযুদ্ধের কারণে দুই কোটির মতো রিফিউজি। তবুও সব কিছু সহনীয়পর্যায়ে আছে। প্রচুর প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া যাতায়াতের জন্য অসংখ্য হলুদ ট্যাক্সি, উন্নতমানের মেট্রোবাস, মেট্রোরেল ও লোকাল বাস চালু রয়েছে। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার, আন্ডারগ্রাউন্ড বা সাবওয়ে ছাড়া কী করে এত মানুষ যাতায়াত করছেন কোনো মারাত্মক অসুবিধা ছাড়াই। প্রশস্ত রাস্তার মধ্যখানে মেট্রোবাস ও মেট্রোরেলের লাইন। স্টেশন ছাড়া কোথাও থামে না।

একটার পর একটা গাড়ি যাচ্ছে, ভেতরে জায়গা নেই, সবাই দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ-সাতটি চলে গেল কোনো বিশৃঙ্খলা, ঠেলাঠেলি বা ধাক্কাধাক্কি নেই; কোনো কথা নেই। বলতে গেলে প্রতি অর্ধমিনিটে বা এক মিনিটে একটা যান আছেই। যেখানে মেট্রো নেই সেখানে প্রচুর লোকাল বাস আছে। ভাড়াও লন্ডনের তুলনায় খুব কম। তুর্কিদের অসম্ভব ধৈর্য। ভদ্রতা ও সাহায্য করার দিক থেকে পশ্চিমের চেয়ে কম নন তুকিরা। ট্রান্সপোর্টে কোথাও কোনো নগদ টাকা-পয়সার লেনদেন নজরে পড়েনি। হয় অটোমেশিন থেকে টিকিট করে নেবেন অথবা একটি অটোমেশিন থেকে একটি কার্ড (ইস্তাম্বুুল কার্ট) বানিয়ে মেশিনের মাধ্যমে টাকা টপআপ করে মেশিনে টাচ করে চলতে থাকুন। তাতে সময় ও অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হয়। শেষ হলে আবার টপআপ করে নিন নতুবা অটো গেট দিয়ে ঢুকতে পারবেন না। এই সিস্টেম সব উন্নত দেশে প্রচলিত। লন্ডনের ওয়েস্টার কার্ডের মতোই। ইস্তাম্বুলে সাহায্য করার জন্য সরকারি লোক দাঁড়িয়ে থাকেন।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ : হেঁটে মেট্রোরেল, মেট্রোবাস, লোকাল বাস এবং সব শেষে এক দিনের জন্য একটি জিপ নিয়ে ইস্তাম্বুলের ইউরোপ ও এশিয়া উভয় অংশে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করলাম। যতটুকু সম্ভব দেখলাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর আছে মনে হলো। খালি জায়গাগুলোতে ঘাস লাগানো আছে এবং উন্নত দেশগুলোর মতো কেটে সুন্দর করে রাখা ও পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক নতুন গাছ লাগানো হয়েছে। জমানো ময়লা বা দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা চোখে পড়ল না। একটি বইয়ে পড়লাম, মাত্র ২০-২১ বছর আগে ইস্তাম্বুলে নাকে কাপড় দিয়ে চলতে হতো। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১৯৮৪ সালে ইস্তাম্বুলে মেয়র হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন জটিল সমস্যা, যেমন- আবর্জনার স্তূপ ও দুর্গন্ধ, ট্রাফিক জ্যাম, পানির চরম অভাব ও বিদ্যুতের সঙ্কট ইত্যাদির মধ্যে প্রথমেই অল্প সময়ে ময়লার দুর্গন্ধ থেকে শহরবাসীকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তারপর অন্যান্য সমস্যাও সমাধান করে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তার ওপর ভিত্তি করে ২০০২ সালে ‘একে’ নামের নতুন পার্টি করে প্রথমবারই মেজরিটি এমপি জিতে সরকার গঠন করলেন। আজো প্রতিটি ইলেকশনে জিতে প্রায় ১৬-১৭ বছর একাধারে ক্ষমতায় আছেন, তা আধুনিক তুর্কি ইতিহাসে বিরল। আজ পর্যন্ত কোনো বিরোধী দল কোনো সময়ই বলতে পারেনি, ভোটে সামান্য কারচুপি হয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ, রাস্তাঘাটে দেশী-বিদেশী কোনো মেয়ে বা মহিলা বা ছেলে চোখেই পড়ল না যাকে বলা চলে, অশালীন পোশাক পরা। তবে কিছু টিনএজ মেয়ের মাথায় কোনো কাপড় নেই। অবশ্য পোশাকে রয়েছে শালীনতা। আধুনিকতার নামে প্রদর্শনমূলক কোনো পোশাক চোখেই পড়ল না। যে হোটেলে ছিলাম, সেখানেও খারাপ কিছু দেখলাম না। এমনকি অ্যালকোহল বা মদজাতীয় কোনো পানীয় আমাদের হোটেলে ছিল না। সবখানে দেখা যায় বেশির ভাগ মহিলা বোরকা পরা অবস্থায়। অসংখ্য তরুণী মাথায় স্কার্ফ পরে চলাফেরা করছে।

যুবকদের মুখে দাড়ি দেখা যায়। অথচ কিছু দিন আগেও তা ছিল না, এমনকি অনেক ইমামও দাড়ি ছাড়াই ইমামতি করতেন। সরকারি অফিস-আদালতে দাড়ি নিয়ে চাকরি করার কথা চিন্তাই করা যেত না। মেয়েদের বোরকা তো দূরের কথা, স্কার্ফ পরাও নিষিদ্ধ ছিল। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, অফিস-আদালতে স্কার্ফ পরা হারাম ছিল। এরদোগানের আমলে মানবাধিকারের সুবাদে স্কার্ফ পরা মাত্র কিছু দিন আগে চালু হলো। এটি যে একটি মুসলিম দেশ, তা ইস্তাম্বুলের সবখানেই মোটামুটি বোঝা যায়। সবাই আবার ধর্মীয় চেতনায় জাতীয় সত্তায় উজ্জীবিত হচ্ছে। এটাই প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং একে পার্টির কারিশমা। বর্তমান যুগে ইসলামবিদ্বেষী বিশ্বমোড়লদের সামনে কাজ করার কুরআন নির্দেশিত হিকমাহ এ পর্যন্ত সফলতা লাভ করেছে।

কয়েকটি মসজিদে নামাজ পড়েছি। মসজিদগুলো একই আকৃতিতে বানানো। প্রতিটি মসজিদের মধ্যখানে উঁচু গম্বুজের ভেতরের দিকে সব দিকে কুরআনের আয়াত সংবলিত রঙিন ক্যালিগ্রাফি সংবলিত কারুকার্য। নীল রঙের কারুকার্যখচিত কুরআনের বিভিন্ন আয়াত মসজিদের চার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়াও প্রায় সব দেয়ালেই কুরআনের আয়াত সুন্দর স্টাইলে লেখা। চার দিকে উঁচু মিনার এবং ইমামদের যাদের সাথে দেখা হয়েছে সবাই যুবক, মুখে ছোট দাড়ি, লম্বা জামা ও মাথায় পাগড়ির মাঝখানে লাল টুপি যা তুরস্ক, মিসর ও জেরুসালেমের ইমাম বা ধর্মীয় আলেমদের বৈশিষ্ট্য।

তুরস্কের মুসলমানেরা বাংলাদেশের মতো ১০০ ভাগ হানাফি মাজহাব অনুসরণ করে থাকেন। তাই আমাদের মতোই নামাজ পড়েন। তবে পার্থক্য হচ্ছে জামাত শুরু হওয়ার আগে মুয়াজ্জিন নির্দিষ্ট উঁচু জায়গায় বসে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত-দোয়া মাইকে পড়েন। আর নামাজের পর ইমাম সাহেবরা মাইকে কুরআন শরিফের কিছু অংশ তিলাওয়াত করে তারপর সবাই মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়েন। এ ছাড়া হজরত আবু আইয়ুব আনসারী রা:-এর মাজার জিয়ারতে গিয়ে দেখলাম, ইমাম সাহেব জোহরের নামাজের আগে ওয়াজ করছেন। আজানের সাথে সাথে ওয়াজ বন্ধ করে যথারীতি নামাজ শুরু করলেন। ইমাম সাহেবদের থেকে দেশের অনেক কিছু জানার ইচ্ছা ছিল। জানতে চেষ্টাও করেছিলাম কিন্তু ইংরেজি তারা জানেন না, কথা বলার মতো আরবিও জানেন না। তবে প্রত্যেক ইমাম অত্যন্ত সহি ও সুন্দর সুললিত মধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করেন। মনে হলো, একমাত্র তাদেরই ইমাম নিযুক্ত করা হয়, যারা সহি ও সুন্দরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন। তুর্কি মসজিদগুলোতে সুন্দর কণ্ঠ ছাড়া কেউ মুয়াজ্জিন হতে পারেন না। তাই সব মসজিদের আজান একই সুরে শোনা যায় এবং তা একজন মুমিনের মন কেড়ে নিয়ে যায়, যা মক্কা ও মদিনা শরিফে অনুভূত হয়ে থাকে।

ইস্তাম্বুলের দর্শনীয় স্থান : সুলতান মসজিদ বা ব্লু মস্ক, আয়া সুফিয়া মসজিদ, তোপকাপি (রাসূলে করিম সা: ও তাঁর পরিবারের ব্যবহৃত কিছু আলামত ও জিনিস সেখানে আছে) হজরত আবু আইয়ুব আনসারীর কবর, বসফরাস ক্রুইজ, গ্রান্ড বাজার ও প্যানোরমা।

তুরস্কে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর বেশির ভাগই ইস্তাম্বুলে অবস্থিত। অনেক দর্শনীয় স্থান একই জায়গায়। নীল মসজিদ, আয়া সুফিয়া মসজিদ, তোপকাপি, সুলতান আহমদ ও সুলতান সেলিমের পরিবারসহ কবর একই এলাকায়। আবার গ্রান্ড বাজারও ব্লু মসজিদের কাছেই।

সুলতান আহমদ মসজিদ বা ব্লু মসজিদ : সবচেয়ে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। আয়া সুফিয়া মসজিদের সামান্য একটু দূরেই ওই মসজিদ। ‘আয়া সুফিয়া’ কারুকার্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাই সুলতান আহমেদ এর চেয়েও সুন্দর করে মসজিদ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তারই প্রমাণ সুলতান আহমেদ বা ব্লু মসজিদ। ইতিহাসবিখ্যাত এই মসজিদ ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। সুলতানের বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। মসজিদের গম্বুজের উচ্চতা ১৪১ ফুট এবং ছয়টি মিনারের উচ্চতা ২১০ ফুট করে। এ মসজিদের অভ্যন্তরীণ কারুকাজ নীল রঙের এবং কয়েক হাজার মার্বেল ব্লু হওয়াতে ব্লু মসজিদ নামেও প্রসিদ্ধ। বিশাল মসজিদে অভ্যন্তরীণ গম্বুুজ ও দেয়ালে কুরআনের আয়াত সংবলিত কারুকার্য দেখার মতো। হাজার হাজার মুসলিম ও অমুসলিম পুরুষ-মহিলা লাইন ধরে মসজিদে এক দিক থেকে ঢুকছেন, অন্য দিক দিয়ে বের হচ্ছেন। প্রত্যেকের জুতার জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগ সরবরাহ করা হয় এবং মহিলাদের স্কার্ফ পরেই প্রবেশ করতে হয়। তাই তাদের ফ্রি স্কার্ফ দেয়া হচ্ছে। অজুর জায়গা ও টয়লেট অত্যন্ত আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও রুচিসম্মত। উল্লেখ্য ২০১৩ সালের হিসাব মতে, দেশটিতে অতীতের প্রায় ৮২ হাজার ৬৯৩ মসজিদ রয়েছে।

তার মধ্যে তিন হাজারেরও বেশি মসজিদ শুধু ইস্তাম্বুল শহরেই। এরদোগানের ১৫ বছর শাসনামলে আরো ১০ হাজার নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। একটি মসজিদ উদ্বোধনকালে তিনি বলেছিলেন, ‘যে মসজিদ সমাজের তথা এলাকার মানুষের কোনো সামাজিক কাজে আসে না, তা নির্মাণের সার্থকতা নেই।’ স্মর্তব্য নবী করিম সা: এই মসজিদের মাধ্যমেই সমাজ তথা দেশের সব কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। সবার সুখ-দুঃখের ও সমস্যার কথা শুনতেন এবং সমাধান দিতেন। সব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম মসজিদে নববী সা: থেকেই পরিচালনা করতেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তা যেন আজ আনুষ্ঠানিক নামাজ ও দু-চার জনের থাকা-খাওয়ার জায়গায় পরিণত হয়েছে।

আয়া সুফিয়া মসজিদ বা হাজী সুফিয়া চার্চ : বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শাসনামলে এটি ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত গ্রিক অর্থোডক্সদের প্রসিদ্ধ চার্চ ছিল। তা ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয়। এটি আর্কিটেকচারাল কাজ ও উঁচু গম্বুুজের জন্য প্রসিদ্ধ। মুসলিমদের ইস্তাম্বুল জয়ের পর এটি মসজিদে পরিণত হয়। আজ পশ্চিমা দেশগুলোতে শত শত চার্চ ক্রয় করে মসজিদে রূপান্তরিত করতে হচ্ছে। এই মসজিদের অদূরেই সুলতান আহমেদ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকে কামাল পাশার শাসনামলে ওই মসজিদকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ব্যর্থ প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এখানে আবার নামাজ পড়া শুরু হয়েছে।

তোপকাপি : রাসূলে করিম সা: ও তাঁর পরিবারের ব্যবহৃত কিছু আলামত ও ব্যবহৃত জিনিস থাকায় এটিকে একটি মিউজিয়াম বলা চলে। যেখানে নবী করিম সা:-এর পায়ের চিহ্ন ও কিছু ব্যবহৃত জিনিস এবং বিভিন্ন সাহাবির ব্যবহৃত তলোয়ার, সে যুগের বল্লম, ঢাল ও চাকু সংরক্ষিত আছে। হজরত ফাতেমা রা: ও হজরত হুসাইন রা:-এর একটি করে জামা এখানে আছে। আমার মনে হয়, আর কোথাও এজাতীয় ঐতিহাসিক জিনিস সংরক্ষিত নেই। হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদের সুবিশাল তলোয়ারসহ কিছু সাহাবির তলোয়ার রয়েছে। পাশেই তুর্কি সুলতানদের যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্রের বিভিন্ন জিনিস রাখা হয়েছে।

হজরত আবু আইয়ুব আনসারী রা:-এর কবর জিয়ারত : হজরত আবু আইয়ুব আনসারী রা:, যিনি তুর্কি ভাষায় সুলতান আইয়ুফ বলেই খ্যাত; তিনি হলেন সেই সাহাবি, নবী করিম সা: হিজরত করে মদিনা বা ইয়াসরিব শহরে যার ঘরে প্রথম উঠেছিলেন। বার্ধক্যে হাদিসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীন কনস্টান্টিনোপল বা ইস্তাম্বুল জয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে সেখানে পৌঁছার আগেই ইন্তেকাল করেন। তার অসিয়ত অনুযায়ী ইস্তাবুলে তাকে কবর দেয়া হয়। আজ সেই শহরে প্রায় সবাই মুসলমান। এই মাজার বিশাল কমপ্লেক্স। হাজার হাজার মুসলমান এক দিক দিয়ে ঢুকে জিয়ারত করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, চিৎকার, কান্নাকাটি, গান-বাজনা ও মাথা ঠোকাঠুুকি কিছুই নেই, যা কোনো কোনো দেশে দেখা যায়। এর কোনো কোনোটি শিরকের পর্যায়ে পড়ে। অথচ আল্লার ওলিরা নবী-রাসূলদের পথ অনুসরণ করে পৃথিবী থেকে শিরক দূর করার জন্য জন্মভূমি ছেড়ে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আমরা সেই মাজার জিয়ারত করে অন্য দিকে বেরিয়ে পড়লাম।

প্যানোরমা নামের জায়গাটি আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে তুর্কি সাম্রাজ্যে সুলতানদের ছবি ও স্মৃতি বিভিন্ন জায়গায় ওয়ালের সাথে লাগানো আছে। সর্বশেষ, একটু ওপরে গিয়ে একটি ঘরের মধ্যে আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে যেন সত্যিকার উঁচু আকাশের চন্দ্র-তারকা এবং সেই যুগে অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখানো হয়, যা দেখে সবাই আসল যুদ্ধ মনে করে ‘ভয়াবহ’ যুদ্ধ ও পরিস্থিতি দেখে কিছুটা ভয় ও কিছুটা আনন্দ উপভোগ করেন। অনেকেই আশ্চর্য হন, কিভাবে এমন দৃশ্য বানানো হয়েছে। এটি দেখার মতো একটি দৃশ্য, যা দেখে বেশি আনন্দ পায় শিশুরা।

গ্রান্ড বাজারে একবার না গেলে যেন নয়। সুলতান মসজিদের কাছেই, যা ইস্তাম্বুল ও তুরস্কে ‘গ্রান্ড বাজার’ নামে প্রসিদ্ধ। সেখানে সব রকম জিনিস পাওয়া যায়। হাজার হাজার টুরিস্ট স্যুটকেস ভরে ক্রয় করছিলেন। তবে মনে হলো; দরাদরি করেই কিনতে হয়। এক দামের দোকানও দেখলাম, যেখানে না গেলে মনে হবে ইস্তাম্বুল সফর অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।

বসফরাস ক্রুইজ : বসফরাস প্রণালী জাহাজে করে এক ঘণ্টা সফর করে প্রণালীর দুই পাশের গড়ে ওঠা বাড়িঘর, মসজিদ ও পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এ ছাড়া অনেক বড় বড় ট্যাংকার, মালবাহী ও যুদ্ধজাহাজও এই প্রণালী দিয়ে চলে। কারণ, এই প্রণালী দুটো সাগর যথা কৃষ্ণ সাগর ও মারমারা সাগরকে সংযুক্ত করেছে। এই প্রণালী এশিয়া ও ইউরোপের সীমানাও বটে। অর্থাৎ এক অংশে ইউরোপ ও অন্য অংশে এশিয়া। ইস্তাম্বুলের মাঝখান দিয়ে, মারমারা সাগর থেকে কৃষ্ণ সাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। ইস্তাম্বুলের বড় দু’টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি ইউরোপে এবং অন্যটি এশিয়ায় অবস্থিত। ইউরোপ অংশে নির্মিত নতুন বিমানবন্দর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর; যেটি গত ২৯ অক্টোবর চালু হয়েছে। কাজ সম্পন্ন হলে বছরে ২০০ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করবে এবং এক লাখ ২০ হাজার লোক কাজ করবে।

ইস্তাম্বুল শহর ঘুরে দেখার জন্য ট্যুর বাস রয়েছে এবং দুই ঘণ্টার সফর প্রতিজনে ৩০-৪০ ইউরো চার্জ করা হয়। ইস্তাম্বুল শহর অনেকটা লন্ডনের মতো, যা টেমস নদীর মাধ্যমে বিভক্ত। দুই দিকের মাঝে ফেরি ও তিনটি ঝুলন্ত ব্রিজ ও সদ্য তৈরি করা সুড়ঙ্গপথে যাতায়াত করতে হয়। পার্থক্য হচ্ছে- বসফরাস একটি প্রাকৃতিক প্রণালী যেখানে বড় বড় জাহাজ যাতায়াত করে, যে কারণে ওই প্রণালীর ওপর দিয়ে ঝুলন্তÍ ব্রিজ দুই পাশে উঁচু পিলারের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। মাঝখানে কোনো পিলার রাখা হয়নি। খুবই উঁচু করা হয়েছে, যাতে জাহাজ চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি না হয়। শেষ ব্রিজটিকে পৃথিবীর মধ্যে প্রশস্ত ঝুলন্ত ব্রিজ বলে দাবি করা হয়, যাতে ১০টি লাইনে গাড়ি চলে।

শেষ কথা : তুরস্কবাসী সবার মধ্যেই সচ্ছলতা পরিলক্ষিত হয়। সবাই কাজে ব্যস্ত। আট কোটি স্থানীয় অধিবাসীর মধ্যে প্রায় চার কোটি টুরিস্টের আগমন। তাই ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ে তুরস্কবাসী খুবই ব্যস্ত। এ ছাড়াও ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রতি বর্তমান সরকার খুবই জোর দিয়েছে। এ কারণে তুরস্কের রফতানি গত ১৬ বছরে বহুগুণ বেড়েছে। অফিসিয়াল বেকারের সংখ্যা দেখা হলেও বাস্তবে বেকার নেই বললেই চলে। দেশ দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এসবের পেছনে একজন ব্যক্তি ও তার দলের অনন্য অবদান। তিনি হলেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার একে পার্টি। শুধু অর্থনৈতিক উন্নতিই হচ্ছে না, সাথে সাথে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক উন্নতিও চলছে যা থেকে তুরস্কবাসীকে বহু দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

তুরস্কবাসীর ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক। ইংরেজি তেমন জানে না, তবুও চেষ্টা করে প্রত্যেককে সাহায্য করার জন্য। যত ব্যস্ততা থাকুক, যদি আপনি কোনো কিছুর সন্ধান চান, নিজের সব কিছু রেখে আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবেনই। যা পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম তার চেয়ে কোনো কমতি ছিল না। সে দেশে আরো থাকতে মন চাইছিল, কিন্তু টিকিট পরিবর্তন করা যাবে না; তাই লন্ডনের পথে রওনা দিলাম। ইনশা আল্লাহ তুরস্কে আবার যাওয়ার ইচ্ছা আছে।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী

E-mail: callaziz786@yahoo.co.uk


আপনার এ্যাড দিন

ফটো গ্যালালি

Islamic Vedio

বিজ্ঞাপন ভিডিও এ্যাড




© All rights reserved © 2018 angina24.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com