বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৩ অপরাহ্ন
আঙিনা ডেস্ক:
শিগগিরি শুরু হচ্ছে হাইস্পিড ট্রেন চলাচলে উপযোগী ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ নির্মাণকাজ। ঢাকা থেকে কুমিল্লার লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এই রেলপথ নির্মাণ করা হবে। হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বলে জানান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
রেলওয়ের ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রেলওয়েকে লাভজনক করতে এ রেলপথে পণ্য পরিবহন বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়। এজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড ট্রেন চালুর প্রকল্প মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে হাইস্পিড ট্রেন চলবে ২০০ কিলোমিটার গতিতে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা। এজন্য নির্মাণ করা হবে এলিভেটেড (উড়াল) রেলপথ। রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রায় ৩০ হাজার ৯৫৫ কোটি সাত লাখ টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প সহায়তা হিসেবে চীন থেকে পাওয়া যাবে ২৪ হাজার ৭৬৪ কোটি ছয় লাখ টাকা। বাকি টাকা জিওবি (বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল) অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, বিশদ ডিজাইন ও নির্মাণকাজের জন্য ইতোমধ্যে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ভারত ও চীনের সঙ্গে রেল সংযোগ উন্নয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড ট্রেন প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক করিডোর বিশেষত বিসিআইএম, আসিয়ান ও ট্রান্সএশিয়ান রেলপথে যুক্ত হতে এটি অবদান রাখবে। পরে রেলপথটি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হতে পারে।
জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা বা লাকসাম দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণ বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে হাইস্পিড ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বর্তমান দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত হাইস্পড রেললাইনের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা থেকে ট্রেন প্রথমে উল্টোপথে টঙ্গী, পরে পূবাইল-ভৈরববাজার-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রামে যায়। হাইস্পিড ট্রেনের রেলপথটি যাবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা-দাউদকান্দি-মোহনপুর-ময়নামতি-লাকসাম-ফেনী-চিনকি আস্তানা-সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রাম। এতে যাত্রীদের সময় বাঁচার পাশাপাশি রেলের অপারেটিং ব্যয়ও কমবে। একইভাবে কমবে পরিবহন ব্যয়ও।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৮ জুন রেলপথ মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা-লাকসাম দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন’-শীর্ষক প্রকল্পের ওপর প্রকল্প যাচাই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে সেকশন বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। এ করিডোরের দৈর্ঘ্য ৩২০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা থেকে ট্রেন বৃত্তাকার পথে টঙ্গী-ভৈরববাজার-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছায়। এতে সময়ের প্রয়োজন হয় ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। প্রস্তাবিত দ্রুতগতির রেলপথটি যাবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মধ্য দিয়ে। এ পথে ঢাকা থেকে কুমিল্লা-লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পিড ট্রেন লাইন নির্মাণ করা হলে সেকশনের দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার কমে যাবে। এতে যাত্রীদের সময় বাঁচার পাশাপাশি রেলের পরিচালন ব্যয়ও (অপারেটিং কস্ট) কমবে। কমবে পরিবহন ব্যয়। একই সঙ্গে যাতায়াতের সময়ও কমবে প্রায় ২ ঘণ্টা। এ রেলপথে প্রতি ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে চলবে ট্রেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিশদ নকশার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। চুক্তি অনুযায়ী ১৮ মাসের মধ্যে চূড়ান্ত নকশা প্রস্তুত করবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সে হিসেবে গত মাসেই (জানুয়ারী) বিশদ আকারে চূড়ান্ত নকশা জমা দেওয়ার কথা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের প্রধান প্রধান আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সম্পন্ন হয় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সবচেয়ে বেশি পণ্য পরিবহন হয়। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়তে থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরের অর্থনৈতিক গুরুত্বও দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া সরকারের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের মাতারবাড়ীতে ‘পাওয়ার হাব’ (বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র) ও সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরের গুরুত্ব আরও বাড়াবে। এ করিডরে ভ্রমণ সময় কমিয়ে আনা গেলে তা বিদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য কার্যক্রম বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দ্রুতগতির রেলওয়ে সার্ভিস চালু হলে এ করিডোরে ২ ঘণ্টার চেয়ে কম সময়ে যাতায়াত করা যাবে। এ সার্ভিস ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলরুটকে করে তুলবে আরও বেশি আকর্ষণীয়। ফলে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, দাউদকান্দি, মোহনপুর, ময়নামতি, লাকসাম, ফেনী, চিনকি আস্তানা, সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এ রেলওয়ের সম্ভাব্য রুট হতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের বেশিরভাগ কাজ চলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই। তাই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনও হয় বেশি। হাইস্পিড ট্রেন চালু হলে ব্যবসায়ীরা দ্রুত পরিবহন সুবিধা পাবেন।
হাইস্পিড ট্রেনের ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রসঙ্গে রেলের কর্মকর্তারা বলেন, এই ট্রেন চালু হলে ঢাকা থেকে ২ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে যাওয়া সম্ভব হবে। বিমানযোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম গিয়ে বিমানবন্দর থেকে দুই নগরী পর্যন্ত সড়কপথে যাতায়াতের সময় যোগ করলে আকাশপথের চেয়েও এতে সময় সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া সহজ হবে পণ্য পরিবহনও। কারণ রাতের একটা বড় অংশের যাত্রীদের যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন হবে না। তখন ওই পথে চলবে পণ্য পরিবহন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রতিদিন ১২ জোড়া ট্রেন চলে। এতে বছরে প্রায় ৩৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করে। আগামী ১০ বছরে এ রুটে যাত্রী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৭৯ লাখ। তখন কমপক্ষে ২৮ জোড়া ট্রেন চলাতে হবে। আর ২০ বছর পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রী চলাচলের পরিমাণ দাঁড়াবে এক কোটি পাঁচ লাখ। সে সময় দৈনিক ৪২ জোড়া ট্রেন চালাতে হবে। বিদ্যমান রেলপথ ও ট্রেনে এ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য হাইস্পিড ট্রেন চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যাত্রীর পাশাপাশি এ পথে বছরে এক কোটি ৫০ লাখ টন পণ্যও পরিবহন করা সম্ভব হবে। Inqilab