বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫০ অপরাহ্ন
দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ কলেজ গ্রাজুয়েট ট্রেসার স্টাডির তথ্য উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলছে, কলেজ গ্রাজুয়েট পুরুষদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছে। নারীদের মধ্যে এ হার আরো বেশি, ৭৭ শতাংশ।
শহর-গ্রামভেদেও এ হারে পার্থক্য রয়েছে। মেট্রোপলিটন এলাকার কলেজ গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৫ শতাংশ হলেও গ্রামাঞ্চলে তা ৭২ শতাংশ। এ হারে পার্থক্য আছে বিভাগভিত্তিক কলেজ গ্রাজুয়েটদের মধ্যেও। মানবিক বিভাগের ৭৪ শতাংশ কলেজ গ্রাজুয়েট বেকার থাকলেও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের গ্রাজুয়েটদের মধ্যে এ হার ৭১ শতাংশ। এছাড়া বিজ্ঞানের ৬৬ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৬৯ শতাংশ কলেজ গ্রাজুয়েট বেকার থাকছেন।
প্রতি বছর ২০ লাখের মতো নতুন মুখ দেশের শ্রমশক্তিতে যুক্ত হচ্ছে। মোট শ্রমশক্তিতে বাড়ছে উচ্চশিক্ষিতদের অংশগ্রহণ। যদিও এদের বড় অংশই বেকার থাকছে। এর মধ্যেও বেশি পিছিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ গ্রাজুয়েটরা। ডিগ্রি সম্পন্নের পর চাকরি খুঁজতেই তিন বছর চলে যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ কলেজ গ্রাজুয়েটের। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে কর্মসংস্থানের প্রস্তুতি ও কলেজ গ্রাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি এ চিত্রকে তারা উদ্বেগজনকও বলছে। দেশে দুই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ মিলছে বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, এর অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ৩০০। প্রতি বছর কলেজের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাব মতে, সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি, যা মোট উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর ৬৮ শতাংশ। প্রতি বছর শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে গ্রাজুয়েট বের হচ্ছেন ৫০ হাজারের মতো।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পড়ালেখা শেষ করে মাত্র ১ শতাংশ কলেজ গ্রাজুয়েট স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত হচ্ছেন। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর তিন বছর ধরে চাকরির সন্ধান করতে হচ্ছে ৪৬ শতাংশ কলেজ গ্রাজুয়েটকে। তাদের মধ্যে বেকারত্বের হারও সবচেয়ে বেশি ৭১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষক সংকট, মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ ও বাজারমুখী কারিকুলামের অভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির বাজার প্রস্তুত না থাকার কারণেও চাকরি পেতে বেশি সময় লেগে যাচ্ছে তাদের।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ হেলাল ইনকিলাবকে বলেন, দেশে শিক্ষিত বেকার বাড়ার পিছনে মূলত কাজ করছে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন না হওয়া এবং সেক্টর অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া। বাংলাদেশে বিভিন্ন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা পাশ করে বের হচ্ছেন তাদের সেক্টরগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারি কিছু উদ্যোগ থাকলেও বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। ফলে তারা সরকারি সেক্টরগুলোতে ঢুকলেও বিষয় অনুযায়ী বেসরকারি সেক্টরে কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। অন্যদিকে এখানে শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করা গেলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলেও বিদেশে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষিতের হার অনুযায়ী দক্ষ জনগোষ্ঠি তৈরী না হওয়ায় পড়ালেখা শেষেও নাগরিকদের একটি বড় অংশকে বেকার থাকতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে সংস্কার ও শিক্ষা ব্যবস্থাতে পরিবর্তন নিয়ে আমাদের আরও ভাবার বিষয় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, একাধিক গ্রাজুয়েটের চাকরি খুঁজতেই তিন-চার বছর লেগে যাচ্ছে। এদেরই একজন নীলফামারীর রুদ্র তালুকদার। ২০১৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিলেও চাকরি হয়নি তার। চাকরি খুঁজতে খুঁজতে কেটে গেছে চার বছরের বেশি সময়। অবশেষে চলতি বছরের শুরুতে একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিতে প্রতিনিধির চাকরি পেয়েছেন এ কলেজ গ্রাজুয়েট।
অন্যদিকে পড়াশোনা শেষ করার পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো চাকরি জোটেনি ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী সাইদুর রহমানের। অর্থনীতি বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে এখন টিউশনি করে চলতে হচ্ছে তাকে। পাশাপাশি চলছে চাকরি খোঁজার চেষ্টা।
সর্বশেষ কলেজ গ্রাজুয়েট ট্রেসার স্টাডির তথ্য উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলছে, গ্রাজুয়েটদের বড় অংশেরই দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। তাদের ওপর জরিপ চালিয়ে সংস্থাটি বলছে, এক-তৃতীয়াংশ চাকরিজীবী গ্রাজুয়েট মনে করেন, কলেজে শেখা জ্ঞান ও দক্ষতা তারা কাজে লাগাতে পারছেন। অধিকাংশ কলেজ গ্রাজুয়েটই তাদের কলেজে শেখা জ্ঞান কাজে লাগাতে পারেন না। বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র একজন জানিয়েছেন, কলেজে শেখা আইসিটি জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নেহাল করিম ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবার পেছনে অনেকাংশে দায়ী এখানকার সরকারের নীতি ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব ব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর এখানে বৃহৎ কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য আশানুরূপ বিনিয়োগ করেন না। তাই এখানে চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠির মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ার পেছনে সরকারের নীতি অনেকাংশে দায়ী। দেশের তরুণদের চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার মত উদ্যোগ সরকার থেকে গ্রহণ করা হয়নি। সরকার জানেনই না অধীনস্ত বিভাগ ও দফতরসমূহে কত পদ খালি পড়ে আছে। এসব বিষয়গুলোতে আরও সুষ্ঠু তদারকি করা হলে বেকারত্বেও তীব্রতা কিছুটা হলেও কমে আসবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী গ্রাজুয়েট তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার্থীরা যাতে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক পায়, সে বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যৌথ অর্থায়নে সাড়ে ১৬ হাজার কলেজ শিক্ষকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে দেশের ভেতরে ও বাইরে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আইটি শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।