মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ অপরাহ্ন
একজন সরকারি কর্মকর্তা তার ছেলেদের কুরআন মাজীদের হাফেয বানাতে চান। একইসাথে জেনারেল শিক্ষায়ও শিক্ষিত বানাতে চান। এজন্য এরকম একটি প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি করিয়েছেন, যেখানে হিফযের সাথে সাথে জেনারেল শিক্ষাও দেওয়া হয়। এখনো তারা হাফেয হয়নি। স্কুলে পড়াতেও তার কোনো আগ্রহ নেই। এখন ছেলেরা আর মাদরাসায় পড়তে চাচ্ছে না। স্কুলে পড়ার বায়না ধরেছে। এ বিষয়েই হযরতের সঙ্গে পরামর্শ করতে চান- এখন তিনি কী করবেন?
ওই কর্মকর্তা খুলনায় বসবাস করেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী ডাক্তার। এখন এফসিপিএস করছেন। পার্ট-১ শেষ করে পার্ট-২ পড়ছেন। পার্ট-২ খুব কঠিন। এজন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। চাপও বেশি। ফ্যামিলিকে স্বভাবতই সময় বেশি দিতে পারেন না। আর ভদ্রলোকও অফিসের কাজে সারাদিন ব্যস্ত। দু-জনের চাকরির মনোভাব আর পার্থিব চাহিদা ছেলেদের উপর প্রভাব ফেলেছে। এদিকে দ্বীনদারীর যেটুকু প্রভাব ছিল, তা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে পূর্ণতা পাচ্ছে না। তিনি হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য পুরো পরিবার নিয়ে খুলনা থেকে ঢাকা আসেন।
১৬ অক্টোবর ২০১৮ (সোমবার) হযরতের সঙ্গে দেখা করেন। হযরত তাদের এ বিষয়ে মূল্যবান নসীহত করেন। ওই কর্মকর্তার স্ত্রীর উদ্দেশে হযরত যে নসীহত করেছেন, তা-ই এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ সময়োপযোগী নসীহতটি সর্বসাধারণের জন্য, বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষিত দ্বীনদারদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আল্লাহর কালামের যথাযথ সম্মান ও কদর করার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এর উপর আমল করা হয় না। হযরত এদিকেই ইঙ্গিত করে নসীহত করেন। আল্লাহ সকলকে উপকৃত করুন। -উপস্থাপক]
نَحْمَدُه وَنَسْتَعِيْنُه وَنَسْتَغْفِرُه وَنُؤْمِنُ بِه وَنَتَوَكّلُ عَلَيْهِ وَنَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلّ لَه، وَمَنْ يُضْلِلْ فَلاَ هَادِيَ لَه، وَأَشْهَدُ أَنْ لاّ إِلٰهَ إِلاّ اللهُ وَحْدَه لاَ شَرِيْكَ لَه،وَأَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا عَبْدُه وَرَسُوْلُه. اَمّابَعْدُ: فَاَعُوْذُبِاللهِ مِنَ الشّيْطَانِ الرّجِيْم، بِسْمِ اللّٰهِ الرّحْمٰنِ الرّحِيمِ. وَ ذَكِّرْ فَاِنَّ الذِّكْرٰی تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِیْنَ. صَدَقَ اللهَ الْعَظِيْمُ.
اَللّٰهُمّ صَلِّ عَلٰى سَيِّدِنَا وَمَوْلَانَا مُحَمّدٍ وَعَلٰى اٰلِ سَيِّدِنَا وَمَوْلَانَا مُحَمّدٍ وّبَارِكْ وَسَلِّمْ.
আমি অসুস্থ। পারকিনসন ডিজিসের কারণে অনেক ঔষধ খেতে হয়। কোনো একটা মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জিব বেরিয়ে আসে। এজন্য কথা স্পষ্ট হয় না। ভাঙাচোরাভাবে দু-একটা কথা বলছি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ ذَكِّرْ فَاِنَّ الذِّكْرٰی تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِیْنَ.
মনে করিয়ে দাও। নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেওয়া আমার ঈমানদার বান্দাদেরকে উপকৃত করবে। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৫
এটি সূরা যারিয়াতের আয়াত। আল্লাহ তা‘আলা এ কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলছেন। ভালো কথা, আল্লাহর কথা, রাসূলের কথা মানুষকে শোনাও। বান্দাদের তা শোনালে, তাদের মনে করিয়ে দিলে তা তাদের উপকৃত করবেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি মনে করিয়ে দেওয়া। আর পুরনো কথাই মনে করিয়ে দেওয়া হয়। আমিও এই আয়াতের অনুকরণে আপনাকে কিছু কথা মনে করিয়ে দেব।
আপনার ছেলেদের কুরআন হিফয করা ভার্সাস তাদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কীভাবে? আপনি তো ডাক্তার। আমার চেয়ে ভালো জানেন। মেয়েদের ওভাম শত শত। মাত্র একটি ওভাম প্রয়োজন হয়। পুরুষের শুক্রাণু আছে লক্ষ লক্ষ। মাত্র একটি প্রয়োজন। মায়েদের একটি ওভাম আর পুরুষের একটি শুক্রাণু মিলে হয় নুতফা। নুতফার ডায়ামিটার কত? ১০-১ মিলিমিটার। মানে এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ। কত ছোট! বলপয়েন্ট কলমের নিব দিয়েও আপনি এত ছোট ফোঁটা দিতে পারবেন না। সোনামুখী সুঁই দিয়ে হয়তো পারবেন। ওইখান থেকে আমাদের শুরু। আল্লাহ তাআলা সূরা মুমিনে বিস্তারিতভাবে এ বিষয়টি বলেছেন।
আমরা দুনিয়ার চারিদিকে যা দেখি তা দেখেই প্রভাবিত হয়ে যাই। সাহাবায়ে কেরাম তো এভাবে দ্বীন পালন করেননি। তাঁরা পুরো সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সারা মক্কা ছিল তাদের বিরুদ্ধে। আবু বকর রা.-এর মতো সম্মানিত ব্যক্তি-মক্কার লোকেরা তাকে ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত-তাকেও মার খেতে হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাঁচাতে গিয়ে কাফেররা তাকে এত মার মেরেছে যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। কিসের বিরুদ্ধে তাদের এভাবে লড়াই করতে হয়েছে? অবিশ্বাস, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে।
এই যামানায় আমরা যারা ছেলে-মেয়েদের কুরআনের হাফেয বানাতে চাই, তাদের মনে কেবলই আসে, বাচ্চারা খাবে কী করে? এটা আল্লাহ রহস্য করে রেখেছেন; দেখি আমার বান্দারা কী করে। তাদের একটু পরীক্ষা করে দেখি। তিনি আমাদের বিবেক-বিবেচনার দিকে ইশারা করেছেন। আমাদের কোত্থেকে বানিয়েছেন তিনি? কুরআনে বার বার বলেছেন-
اَوَ لَمْ یَرَ الْاِنْسَانُ اَنَّا خَلَقْنٰهُ مِنْ نُّطْفَةٍ فَاِذَا هُوَ خَصِیْمٌ مُّبِیْنٌ.
মানুষ কি ভেবে দেখে না তাকে শুক্রবিন্দু থেকে তৈরি করেছি আমি। অথচ সে প্রকাশ্যে ঝগড়া করে। -সূরা ইয়াসিন (৩৬) : ৭৭
মানুষ কি একটু চিন্তা করে না, কী থেকে তাকে বানিয়েছি আমি? তারপর সে আমার সঙ্গে অহংকার করে। পুনরুত্থানকে অবিশ্বাস করে। জান্নাত-জাহান্নামকে অস্বীকার করে।
(পর্দার আড়ালে থাকা ভদ্রলোকের স্ত্রীকে লক্ষ করে বললেন) আপনি বলতে পারবেন, একজন মায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কী? ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, সন্তান লালন-পালন করা।
বাচ্চাদের লালন-পালন করা তো সহজাত। কিন্তু তার আসল দায়িত্ব কী? মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. কুরআন মাজীদের একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেন। আল্লাহ বলেন-
وَ مِنْ اٰیٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَیْهَا.
তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও। -সূরা রূম (৩০) : ২১
আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি নিদর্শন হচ্ছে আমাদের স্ত্রীগণ। স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে স্বামীকে শান্তি পৌঁছানো (So that husband gets rest in them)। রান্না-বান্না করাও না। লালন-পালন করাও না। যে কোনো স্ত্রীর প্রধান কাজ হচ্ছে, স্বামীর দেখভাল করা (Of any wife, her only duty is to look after her husband)। সমাজে এ কথার কি কোনো দাম আছে? আধুনিক লোকেরা এ কথা শুনলে হাসে।
কেবল আলোচনার জন্য বলছি, আপনার এফসিপিএস নিয়ে ব্যস্ত থাকা আর আল্লাহ আপনাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন-স্বামীকে শান্তিতে রাখা-কখনো চিন্তা করেছেন, আপনি এ দায়িত্ব পালনে কতটুকু সমর্থ হচ্ছেন? আপনারা যারা ডাক্তারীর বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছেন, একটু চিন্তা করেন তো ঢাকা শহরে যত বড় বড় হাসাপাতাল আছে, যেখানে রোগী দেখা হয়, তাদের মধ্যে কতজন হবেন মহিলা? কত পার্সেন্ট হবে? বলেন, আপনি আমার মেয়ের মতো।
তখন ভদ্রলোকের স্ত্রী পর্দার আড়াল থেকে বলল, খুব বেশি না। তবে গাইনোকোলজিস্টের সংখ্যা অনেক আছে।
আলহামদু লিল্লাহ। এখন সেখানে শরীয়তের হুকুমের কোনো পরওয়া করা হয়? নামাযের কোনো পাবন্দি করা হয়? নামাযের ইহতিমাম করা হচ্ছে সর্বনিম্ন। আপনি ইচ্ছা করেছেন, আপনার ছেলেমেয়েদের হাফেয বানাবেন। কিন্তু আপনি এর সঙ্গে ভেজাল দিচ্ছেন। ইংরেজি-বাংলা-অংক এগুলো শিখতে হবে। আমি বলি, এগুলোর সঙ্গে কুরআন মাজীদের ব্যবহার সতীনের মতো। কুরআন মাজীদ একদিকে, অন্যদিকে হলো ইংরেজি শিক্ষা। কুরআন মাজীদ বলে (যেন বলে), তুমি তোমার সীনার মধ্যে আমার সতীনকে রেখেছ (দুনিয়ার ডিগ্রি, পদমর্যাদা ইত্যাদি) আমি তোমার সীনায় যাব না। কেন বলে? আমি আমার মতো করে বলছি। আপনি কি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন? কুরআন মাজীদ যেন বলে, তোমার সীনায় তুমি ইংরেজি-বাংলা সব সমান সমান পৌঁছাতে চাও, আমি আল্লাহর কালাম, আল্লাহ আসমান-যমীন বানিয়েছেন, তাকে তুমি এত সাধারণ মনে করলে? এখানেই রোগের মূল (জড়ড়ঃ ড়ভ ঃযব ফরংবধংব)। আল্লাহ বলেন-
بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا، وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی.
(আল্লাহ তাআলা অনেক আক্ষেপের সঙ্গে বলেন,) না না না, তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখেরাত অনেক ভালো, চিরস্থায়ী। -সূরা আলা (৮৭) : ১৬-১৭
হায় তুমি তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিলে। অথচ আখেরাত লক্ষ লক্ষ বছর না, কোটি কোটি বছর না-আরও দীর্ঘ। আল্লাহ তোমাকে বানিয়েছেন আখেরাতের জন্য। তুমি আমার কুরআনের সঙ্গে দুনিয়ার ডিগ্রি, দুনিয়ার পদমর্যাদা রাখতে চাচ্ছ? দুনিয়া আমাদের ধোঁকায় ফেলছে। আপনার মানিকদের আপনি হাফেয বানাতে চান, এজন্য কয়েকটা কথা বললাম। এখন দেরি হয়ে গেছে। তারপরেও আমি দু-জন ছাত্রকে দেখিয়েছি।[1] ওদের আব্বু ওই দ্ইু ভাইকে দেখেছেন। তারাও উক্ত প্রতিষ্ঠানে ভালো রেজাল্ট করছিল। কিন্তু সেটা ছেড়ে এখানে এসে তারা অতি অল্প সময়ে হাফেজ হয়ে গেছে। কুরআন ত্যাগ চায় (Quran demands sacrifice)। তুমি দুনিয়ার শিক্ষা ঢুকালে আমি তোমার সীনায় যাব না।
এখানে আমি ভিন্ন একটি বিষয় বলছি। আপনার সামনে আমার স্ত্রী বসে আছেন। তিনি মাস্টার্স পাশ করেছেন ১৯৭০ সালে। তারা পাঁচ ভাই ও চার বোন। বড় ভাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, জয়েন্ট সেক্রেটারী পদমর্যাদায় রিটায়ার করেছেন। তার পরের ভাই ডাক্তার, কানাডায় থাকেন, পিএইচডি করেছেন। তার পরের ভাইও ডাক্তার। তার পরের ভাই বিমানে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তার পরের ভাই একটি অয়েল কোম্পানীর উচ্চ পদে আছেন। তার কোনো বোনই তার মতো মাস্টার্স পাশ করতে পারেননি। এই নয় ভাইবোন সব একদিকে। এখনো একদিকে। এখনো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৌভাগ্য দেন।
আল্লাহ আপনাকে তৈরি করেছেন। মায়ের পেটে তৈরি করেছেন। কুরআন এটির স্বীকৃতি দেয়। মায়েদের সম্পর্কে কুরআন বলে-
حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ كُرْهًا وَّ وَضَعَتْهُ كُرْهًا .
His mother carried him with difficulties (তার মা তাকে বড় কষ্টে পেটে বহন করেছে)। বড় কষ্টে প্রসব করেছে। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১৫
কত কষ্টে তার মা তাকে বহন করেছে। কিয়ামতের ময়দানে দেখা যাবে, কোনটা ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, কোনটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তখন আর ফিরে আসার উপায় নাই। একান্তই আমাদের অতি স্নেহভাজন ও তার স্ত্রীর জন্য একটু স্যাম্পল কথা বললাম।
সারা দুনিয়ার মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদের, কুরআন মাজীদের সঙ্গে সম্পর্ক কী রকম বলেন দেখি? কুরআন পড়লে যেহেতু পয়সা পাওয়া যায় না, ডিগ্রি পাওয়া যায় না, সম্মান পাওয়া যায় না, এজন্য এটিকে চরম অবহেলা করা হয়। কুরআন মাজীদে এ বিষয়টি বার বার আলোচনা করা হয়েছে। সূরা ওয়াকিয়ার আয়াত-
اَفَبِهٰذَا الْحَدِیْثِ اَنْتُمْ مُّدْهِنُوْنَ.
তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করবে? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৮১
এই কুরআনের সঙ্গে এত অবহেলা করছ? এটিকে খুব সাধারণ মনে করছ? কুরআন মাজীদের ১১৪টি সূরার মধ্যে প্রায় বেশিরভাগ সূরাতেই কুরআন মাজীদ নিজেই তার কথা আগে বলেছে।
الٓمّٓ، ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ فِیْهِ.
আলিফ-লাম-মীম। এটা সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই। -সূরা বাকারা (২) : ১-২
কী সন্দেহ নেই? এখানে কোনো বক্তব্য নেই। কুরআন শরীফের একুশ পারায় এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে-
تَنْزِیْلُ الْكِتٰبِ لَا رَیْبَ فِیْهِ مِنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে এই কিতাবের অবতরণ- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। -সূরা সাজদা (৩২) : ২
রাব্বুল আলামীনের নিকট থেকে এসেছে এই কুরআন। সেই মেসেজের দিকে তোমরা এত অবহেলা করছ? চিন্তা করে দেখেন। আপনি গাইনোকোলজিস্ট এক্সপার্ট হন, আল্লাহ কবুল করুন। কিন্তু ক-জন ডাক্তার সূরা ফাতিহা ঠিক করে পড়তে পারবে? আমপারা থেকে একটি সূরা শোনাতে পারবে? আপনার সঙ্গে যারা এফসিপিএস করছেন, তাদের কয়জন কুরআন মাজীদের একটি পৃষ্ঠা পড়তে পারবে? আমিও এমনই ছিলাম। আমাকে একজন আল্লাহর ওলীর সংস্পর্শ এ পথে নিয়ে এসেছে। তার নাম মাওলানা আব্দুল্লাহ রাহ.। আযীমপুর কবরস্থানের মসজিদের ইমাম ও খতীব। তিনি আমাকে বললেন, ‘হামীদুর রহমান ভাই, একজন হাফেজের সঙ্গে বাচ্চাগুলোকে রেখে দেন। খেলতে খেলতে হাফেজ হয়ে যাবে। ইংরেজি-বাংলা- সে তো আকাশে-বাতাসে আছে।’
এখন ওদের বাবা আমার বাচ্চাদের পরীক্ষা করে দেখুক। তারা তো ফরমালি বাংলা-ইংরেজি পড়েনি। Quran demands you be for me; আর নইলে তোমার সীনায় যাব না। তোমার কাছে কোনটার গুরুত্ব বেশি?
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আদম আলীর সঙ্গে আমেরিকা যাওয়ার। ২০১২ সালে। আমি তখন জর্জিয়া স্টেটে আটলান্টার একটি বুকস্টোর থেকে একটি বই কিনলাম। বইটির নাম আই লাভ মাই মম (I love My Mom)। পুরো বইটির মধ্যে প্রতি পৃষ্ঠায় ছবি। আর লেখা : আমার মা আমার জন্য এই এই করে, এজন্য আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু মাকে কে তৈরি করেছে, তার সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। চিন্তা করেন তো!
আল্লাহ আমাদের মায়েদের পেটে কি এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে তৈরি করেছেন। কিন্তু যিনি তৈরি করলেন, তার নামও নেওয়া হয় না। আল্লাহ না-ই বলল, গড (God) না-ই বলল, ক্রিয়েটর (Creator) তো বলতে পারে? তিনি সূর্য তৈরি করেছেন। সারা পৃথিবী জুড়ে অক্সিজেন বেষ্টন করে আছে। তার পার্সেন্টেজ সব জায়গায় একইরকম। অক্সিজেন কে বানিয়েছেন? তাঁর কি একটা ‘থ্যাংক ইউ’ পাওয়ার অধিকার নেই? আপনারা ভালো করেই জানেন, আমরা কিসের মধ্যে ডুবে আছি এখন? অক্সিজেন। আপনাকে কে বানিয়েছে? তাঁকে কোনো ‘থ্যাংক ইউ’ দেওয়া হয়?
পানি-এখন তো কিছু পানির জন্য পয়সা দিতে হয়-কত গ্যালন পানি বৃষ্টি থেকে পড়ে? কত টন টন পানি পড়ে? কে বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন এটি? তাঁকে খুশি করার চেষ্টা কোথায়? একটুখানি সমালোচনা হলে আমরা ভয় পেয়ে যাই। কবরে আমাকে একাই যেতে হবে। যাদের আমরা ভয় করছি-কেবলই সমালোচনা, কেবলই কিছু কথা-এরকম ভয় সাহাবায়ে কেরাম করেননি। এ যামানায় হাফেয হওয়া সাহাবীদের অনুসারী হওয়ার অর্ধেক। বাকি অর্ধেক আমল-আখলাক। ব্যাস, আল্লাহ তাআলা উপকার দেওয়ার মালিক। আল্লাহ যে বলেছেন-
وَّ ذَكِّرْ فَاِنَّ الذِّكْرٰی تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِیْنَ.
মনে করিয়ে দাও। নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেওয়া আমার ঈমানদার বান্দাদেরকে উপকৃত করবে। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৫
আমি কেবলই আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম। কোথায় ছিলেন আপনি, কোথায় ছিলাম আমরা? কোথায় তিনি আমাদের তৈরি করেছেন, আর কোথায় আমাদের ফিরে যেতে হবে? কী অদ্ভুত কা-। আবার আমাদের জন্মের আগেই সবকিছু তৈরি করে রেখেছেন। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে আমরা বাঁচি। সেটির বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। বাতাস লাগে। সেটির বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।
আমি ওই আমেরিকার সফরে ডালাসে এক বাড়িতে ছিলাম। সেখানে বাড়ির সামনে খালি জায়গায় ঘাসগুলো শুকিয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘাসগুলো এত শুকনো কেন?’ আমাদের মেজবান বলল, ‘এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। ডালাস অথরিটি আমাদের বলেছে, পানি সাশ্রয় করতে।’ আধুনিক পৃথিবীর অনেক আবিষ্কারের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাতের কোনো কিছু এখনো হয়ত আবিষ্কার হয়নি। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-
اَفَرَءَیْتُمُ الْمَآءَ الَّذِیْ تَشْرَبُوْنَ ءَاَنْتُمْ اَنْزَلْتُمُوْهُ مِنَ الْمُزْنِ اَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُوْنَ.
তুমি যে পানি পান কর তার সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, তুমি এ পানিকে মেঘ থেকে নামাও, না আমি নামাই? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৬৮-৬৯
আল্লাহ আপনাকে সৌভাগ্যবতী করুন। একটি দুআ আছে,
اَسْعَدَك اللهُ تَعَالٰى فِيْ الدّارَيْنِ.
আল্লাহ আপনাকে উভয় জাহানে সৌভাগ্যবতী করুন। আল্লাহ আমাদের নেক আমল করার তাওফীক নসীব করুন। আমাদের এই মজলিসকে কবুল করুন- আমীন।
পত্রস্থকরণ : মুহাম্মাদ আদম আলী