মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৮ অপরাহ্ন
কাজী মমিন::
শান্তির বয়স আঠারো হবার দুবছর আগেই বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর অন্যান্য বাঙালি মেয়েদের মতই চলছে সুখের সংসার। সাড়ে পাঁচ বছর হয়ে গেলো সংসারের। কাজে ভুল ধরার সুযোগ পায়নি কেউ। অকল্পনীয় ম্যানেজ করে চলার ক্ষমতা মনে হয় উপরওয়ালা তাকে দিয়েছেন।
শান্তি আমার চোখে এক প্রশান্তির নাম। শান্তির সাথে আমার পরিচয় ওর বিয়ের দিন সন্ধ্যা থেকে। বিয়ের দিন সন্ধ্যায় আমার সাথেই প্রথম দেখা। কবুল বলার পর নানুর সাথে বসেছিলো ও। সালাম দিয়ে কাছে গেলাম। পাশে বসলাম। নানু বলল, নাতিন জামাই এই দেখো চান্দের লাহান আমার নাতিনরে তোমার হাতে তুইলা দিলাম। সেই থেকে আমরা এক মানব।
শান্তি আমার কাছে এক প্রশান্তির নীড়। চাওয়া-পাওয়া বেশি না থাকলেও বছর না যেতেই কিছু টাকা দিয়ে বলল ‘আমার জন্য একটা ব্রেসলেট আনা যাবে? বেসলেট আমার খুব পছন্দ।’
সময় যায় বছর যায় শান্তির আবদার ভুলে যাই, টাকাও খরচ করে ফেলি। একটা প্রয়োজনে বন্ধুর সাথে স্বর্ণের দোকানে গেলে একটা ব্রেসলেট নজরে আসে। মনে পড়ে যায় সেই আবদার। দাম জিজ্ঞেস করি। দাম শুনে নিজেকে এই প্রথম আবিষ্কার করি আমিতো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। আমাদের আশা আকাঙকাই হলো বেঁচে থাকার অন্যতম পথ।
কিছু টাকা জমিয়ে মাস চারেক পর কিনে ফেলি একটি স্বর্ণের ব্রেসলাইট। মধ্যরাতের পর তার হাতে তুলে দেই প্যাকেটটি। আমি এত খুশি হতে শান্তিকে কোনদিন দেখিনি। শান্তি শুধু বললো কি দরকার ছিল এই সময়…। আমার কাছে এই প্রথম শান্তিকে কিছু দিতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর আসে।নিয়মিতই সে ব্রেসলেটটি হাতে পরে।
পাঁচ বছরে পরল আমাদের সংসার জীবনের। করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসায় খুব লস খেয়ে যাই। এক সময় মূলধন হারিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় এসে পড়ে। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এককথায় পায়ের নিচে মাটি একেবারেই ছিল না। ঋণের টাকার চাপে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। আপনজন দূরে সরে যাচ্ছে বন্যার স্রোতের মত।
গত কদিনের মতো অনেকের কাছে হাত পেতে যখন খালি হাতে বাসায় ফিরছিলাম ভাবছিলাম কি বলবো শান্তিকে। রাত করে বাসায় আসি। নামাজ পড়ি। আল্লাহকে বলি তোমার ভান্ডারেরতু শেষ নেই, আমাকে কিছু দিতে পারনা আল্লাহ! তোমার ভান্ডার থেকে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দাও ওগো আল্লাহ।
শান্তি রাতে কিছুই বলল না মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে বের হওয়ার সময় শান্তি এসে সামনে দাঁড়ায় হাতে একটা মুষ্টিবদ্ধ ওড়না। আমার হাতে দিয়ে বলে ‘এগুলো বিক্রি করলে কিছু টাকা হবে আংশিক হলেও ঋণ পরিশোধ হবে, আল্লাহ চাইলে এর চাইতে আরো ভালো জিনিস আমাদের হবে ইনশাআল্লাহ।’ তার দিকে না তাকিয়েই হাতে নিলাম। স্বর্ণের দোকানে গিয়ে পুটলাটা খুললাম। একটা গলার হার, একটা নাকের একটা নোলক, একজোড়া কানের দুল, দুটি আংটি আর সবশেষে নিচে পড়ে আছে সেই ব্রেসলেইটটি। শুধুমাত্র ব্রেসলেটটি দেখে চোখের কোনে ক’ফোঁটা পানি জমতে শুরু করেছিলো কিন্তু তা হতে দেইনি, দিতে পারিনা, দেবার সুযোগ নাই। ব্রেসলেটটি রেখে দেবার আহলাদ করার মতো বাস্তবতা আজ নেই।
টাকা হাতে নিলাম। ঋণের এক দশমাংশ পরিশোধ করতে পারবো আজ।মাথা নিচু করে সামনে পা বাড়ালাম…
ও হে, ব্রেসলেট এর একটা ছবি তুলে রেখেছি…