বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০৯ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রাচীন বাংলার গৌড় জনপদের রাজা ক্ষেত্রপালের স্ত্রী সুরম্যার নামেই সুরমা নদীর নামকরণ বলে জানা যায়। নদীটি শরাবতী নামেও পরিচিত। রাজপতি ক্ষেত্রপাল বরাক থেকে লোভার সংযোগ পর্যন্ত একটি খাল খনন করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। এটিই সুরম্যা বা সুরমা নামে পরিচিত। ভারতের বরাক থেকে উৎপত্তি হওয়া এই নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসিদ থেকে সুরমা-কুশিয়ারা দুটি ধারায় বাঁক নিয়েছে আলাদা নামে। এককালের খর¯্রােতা এই নদীর গতিপথ এখন বদলে গেছে। স্থানে স্থানে জেগেছে চর। কিছু স্থান দখলদারদের কবলেও পড়েছে।
বাংলাদেশ বিআইডাব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জকিগঞ্জের অমলসিদ থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত সুরমার দূরত্ব প্রায় ২০৪ কিলোমিটার। সুনামগঞ্জ থেকে পৈন্দা পর্যন্ত মূলধারাটিই সুরমা নামে পরিচিত। পৈন্দা থেকে দিরাই উপজেলার চাঁনপুর হয়ে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার মারকুলি এলাকায় কুশিয়ারা নদীতে মিলিত হয়েছে সুরমার এই প্রধান ধারা। এটি এখন মৃতপ্রায়-পুরান সুরমা নামে অভিহিত। এই ধারায় মিলিত হওয়ার আগে সুরমা নদীর এই শাখাটি দিরাই উপজেলার চাঁনপুর হয়ে সুজানগর থেকে আজমিরীগঞ্জে গিয়ে আবার কালনী নদীতে মিশেছে। এই ধারাটি ‘মরা সুরমা’ নামে পরিচিত।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নদীর গতিপথ নষ্ট হচ্ছে, নাব্যতা হারাচ্ছে ও চর পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পুরান সুরমা ও মরা সুরমা এখন বলতে গেলে মৃতপ্রায়। সরাসরি বর্তমানের মূল সুরমাতে বড় নৌকা নিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই।
সুরমার দ্বিতীয় শাখাটি পৈন্দা থেকে পশ্চিম দিকে নৌয়া নদী নামে আট কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে উত্তর-পশ্চিমে আরেকটু মোড় নিয়ে আরো ৯ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে। সেখানে জামালগঞ্জের লালপুরের কাছে বৌলাই নদীতে বাঁক নিয়েছে সুরমা। পরবর্তী সময়ে ঘোড়াউত্রা নাম নিয়ে দিলালপুরে গিয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এখানে গিয়েই সুনামগঞ্জের সীমানা শেষ করেছে সুরমা নদীর দ্বিতীয় ধারাটি। তবে দীর্ঘ এই নদী যাত্রাপথে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আছে। স্থানে স্থানে জেগেছে চর। ভরাট হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে তীরও দখল করে স্থাপনা তৈরির হিড়িক দেখা গেছে।
প্রবীণরা জানিয়েছেন, একসময়ে কলকাতা থেকে ছাতক পর্যন্ত সুরমা নদীতে সরাসরি স্টিমার চলাচল করত। নদীটি গভীর ও প্রশস্ত থাকায় ছাতক থেকে ভৈরব পর্যন্তও স্টিমার চলত। বরাক নদীর ৪০ ভাগ জলই ধারণ করত সুরমা নদী। ১৯৫৪-১৯৭০ সাল পর্যন্ত একটি প্রকল্পে সুরমা নদীর বক্র খাদ কেটে সোজা করা হয়েছিল।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ছাতক-জামালগঞ্জ অংশের সুরমা নদীতে এই মৌসুমে পানি গড়ে ১৫ মিটার থাকে। প্রতিটি পয়েন্টেই ৪০-৫০ ফিট পানি রয়েছে। তবে বিভিন্ন অংশ বা পয়েন্ট পানিপ্রবাহের কারণে গতিপথ বদলে ভেঙে বড় হওয়ায় মূল পথে চর পড়েছে। এতে স্বাভাবিক নাব্যতা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নৌচলাচলও বিঘিœত হচ্ছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ৫১টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রথম পর্যায় ২৪টি নৌপথ প্রকল্পে ছাতক থেকে জামালগঞ্জ পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার খননকাজ চলছে। ২০১২-২১ মেয়াদের এই প্রকল্পে সুরমা নদীসহ দেশের ২৪টি নৌপথ খননে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। এ বছর সুরমা নদীর কানাইঘাট-ছাতক পর্যন্ত ১২৫ কিলোমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য আরো একটি প্রকল্প গ্রহণ করে ডিপিপি চূড়ান্ত করে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জের পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, পুরান সুরমা ও মরা সুরমা আজ মৃতপ্রায়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই দুটি ধারায় বড় নৌকা চলাচল করতে পারছে না। বর্তমানের মূল ধারার ছাতক-জামালগঞ্জ পর্যন্ত সুরমা নদীর বিভিন্ন অংশ ভরাট হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার টুকের বাজার এলাকায় নতুন বাঁক নিয়ে ভরাট হয়ে গেছে সুরমা নদী। জামালগঞ্জের গোলকপুরের পাশের সুকদেবপুরেও বেশ কিছু অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া ছাতক ও দোয়ারাবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টেও চর পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। বাঁক নেওয়া ও ভরাট হয়ে যাওয়া এই অংশই বিআইডাব্লিউটিএ খনন করছে বলে জানা গেছে। তবে তারা কোথায় কিভাবে খনন করছে তা কারো জানা নেই বলে জানিয়েছেন পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা।
নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ‘সুরমা, স্থান বিশেষে ধনু নদীটি’ দীর্ঘদিন ধরে খননের অভাবে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর হাওরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ওই নদীটি এভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ায় চৈত্র মাসে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এলাকার ফসলরক্ষা বাঁধগুলো ভেঙে বা উপচে হাওর এলাকার কৃষকের বছরের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যায়। পাশাপাশি ওই নৌপথে নৌযান চলাচলেও মারাত্মক বিঘœ ঘটছে। এ ছাড়া নদীতে আগের মতো পানি না থাকায় হাওর এলাকায় মাছের উৎপাদনও দিনে দিনে কমে আসছে। সেচ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার কৃষকরা। হাওর এলাকার কৃষক, জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলাধীন ধনু নদীর তীরবর্তী চাঁনপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হাই (৬০) বলেন, ১৫-১৬ বছর আগেও ধনু আর সুরমা নদী দিয়ে বড়-বড় লঞ্চ, স্টিমার, কার্গো চলাচল করত। কিন্তু এখন নদীটি খননের অভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ায় মালবোঝাই বড় নৌকাও ঠিকমতো চলাচল করতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, আগে ওই নদীতে অনেক পানি থাকত। তখন এলাকার নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে প্রচুর মাছও পাওয়া যেত। আর সে সময়ে হাওরের বেড়িবাঁধ নিয়েও আমাদের তেমন সমস্যায় পড়তে হতো না।
ওই নৌপথে চলাচলকারী এমভি চান্দ সওদাগর কার্গোর চালক মো. ইমন মিয়া বলেন, সিলেট, ছাতক ও সুনামগঞ্জ থেকে সিমেন্ট, বালু-পাথর, কয়লাসহ বিভিন্ন মালবোঝাই করে ওই নৌপথ দিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন আমাদের ওই নৌপথে অর্ধেক বোঝাই করেও কার্গো চলাচলে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে। তাই শিগগিরই ওই নদী ভালো করে খনন করা না হলে এ নৌপথে মাল বোঝাই করে সব নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
হাওর বাঁচাও-সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির সদস্যসচিব চয়ন কান্তি দাস বলেন, সুরমা তথা ধনু নদীসহ হাওর এলাকার সব কয়টি নদী, খাল-বিল, জলাশয় ভালোভাবে খনন করা হলে চৈত্র মাসের শেষের দিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধগুলো অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত রাখা যেত।
মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, সুরমা ও ধনু নদীসহ হাওর এলাকার ছোট-বড় সব নদীই খননের অভাবে নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। আর এরই বিরূপ প্রভাব পড়ে আমাদের ফসলরক্ষা বাঁধের ওপর। তাই আমি দ্রুতই এলাকার সব কয়টি নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয় খননের জোর দাবি জানাচ্ছি।