বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৮ অপরাহ্ন
মো. আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম ::
লেখাটি S.T.Coleridge এর লেখা দু’টি লাইন দিয়ে শুরু করা যাক-
"Water, water, every where,
Nor any drop to drink." (The Rime of the ৷ Ancient Mariner,” by S. T. Coleridge.)
অর্থাৎ পানি আর পানি, সর্বত্র পানি,
পান করার মতো নেই এক ফোটাও।
আগামীর বিশ্বে বিশুদ্ধ পানি পাওয়াই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এমনকি বিশ্বব্যাপি পানি নিয়েই দেখা দিবে দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত। পৃথিবীর ১০০ ভাগের ৭০.৯% পানি থাকার পরেও কেন এই আশংকা…? তা’ই না! তাহলে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনায় আসা যাক।। পানি বা জল হলো একটি অজৈব, স্বচ্ছ, স্বাদহীন, গন্ধহীন এবং প্রায় বর্ণহীন এক রাসায়নিক পদার্থ। জল বা পানির রাসায়নিক সংকেত হল H2O।
ইউপ্যাক (IUPAC) নিয়ম অনুযায়ী পানির রাসায়নিক নাম ডাইহাইড্রোজেন মনোঅক্সাইড। অর্থাৎ জল বা পানির একেকটি অণু একটি অক্সিজেন পরমাণু এবং দু’টি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমযোজী বন্ধনে গঠিত। এই H2O যৌগটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল – অপেক্ষাকৃত অল্প তাপমাত্রার পরিসরের মধ্যে এর তিনটি ভিন্ন অবস্থা।যথাক্রমে কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থা। এক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে ০°–১০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে H2O তরল অবস্থায় থাকে, এই তরল H2O-কেই আমরা পানি বা জল বলি। ০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জল বা পানি জমে কঠিন বরফে পরিণত হয় এবং ১০০° সেলসিয়াসে জল বায়বীয় অবস্থা জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়। এই জন্য ০° সেলসিয়াসকে বলা হয় জল বা পানির গলনাঙ্ক (freezing point) এবং ১০০° সেলসিয়াসকে বলা হয় জল বা পানির স্ফুটনাঙ্ক (boiling point)। গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্কের এই মান (যথাক্রমে, ০° ও ১০০° সেলসিয়াস) এক বায়ুমণ্ডলীয় চাপেই পরিলক্ষিত হয়।
বলে রাখা ভাল বায়ু-চাপের পরিবর্তনের সঙ্গে সমস্ত পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্কের মানের পরিবর্তন হয়। জলীয় বাষ্প ঊর্ধ বায়ুমণ্ডলে ঠাণ্ডা হয়ে যখন সূক্ষ্ম জল-কণা ও বরফ-কণায় রুপান্তরিত হয়, তখন তাকে আমরা বলি মেঘ। যখন জল-কণাগুলি আকারে বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর ওপর নেমে আসে, তখন তাকে বলি বৃষ্টি (rain)। যখন বরফ-কণাগুলি আকারে বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীর ওপর নেমে আসে, তখন তাকে বলি তুষার-পাত (snow-fall)। এখানে আরও বলা যেতে পারে, পৃথিবীতে তরল স্ফুটিক রূপেও পানির অস্তিত্ব দেখা যায়। রাসায়নিক যৌগের নামকরণ প্রক্রিয়া অনুসারে পানির (জলের) বিজ্ঞানসম্মত নাম হল dihydrogen monoxide (ডাইহাইড্রোজেন মনোক্সাইড)। কিন্তু এই নামটি প্রায় কোথাও ব্যবহৃত হয় না।
পৃথিবীতে প্রাপ্ত পানির ৯৬.৫% পাওয়া যায় মহাসাগরে, ১.৭% ভূগর্ভে। এমনকি আমাদের রক্তের ৮৩ ভাগ, হাড়ে ২২ ভাগ, মস্তিষ্কে ৭৪ ভাগ, পেশিতে ৭৫ ভাগ পানি থাকে, অর্থাৎ আমাদের শরীরের দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে পানি। কিন্তু এই পানিই হবে বিশ্বের পরাশক্তি দেশ গুলোর প্রধান হাতিয়ার। মহাসাগর,সাগর,নদ-নদী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বকে আয়ত্তে রাখারও মুখ্যম মাধ্যম হবে পানি। ২০২৫ সালের মধ্যে পানি-অপসারণের ঘটনা উন্নত বিশ্বে ৫০ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়। উদাহরণ হিসেবে, আফ্রিকা মহাদেশে মিঠাপানির অনুলব্ধতা অচিরেই ৭৫ থেকে ২৫০ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে। ২০২৫ সালের মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই পানির অভাবে পড়বে পৃথিবীর ১.৮ বিলিয়ন মানুষ, আর পানি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার মধ্যে।
নভেম্বর, ২০০৯-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে কয়েকটি উন্নয়নশীল অঞ্চলে যোগানের তুলনায় পানির চাহিদা ৫০% ছাড়িয়ে যাবে। এবার ফিরে তাকানো যাক দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। দক্ষিণ এশিয়া’ বলতে বুঝায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভারত,চিন, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান। বিশ্বের জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ এ অঞ্চলে বাস করে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার অনেকগুলো দেশই দক্ষিণ এশিয়াতেই অবস্থিত। কেবল ঘনবসতি হিসেবেই নয়, বিশ্বে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরিচয় হলো দারিদ্র অঞ্চল হিসেবে। বিশ্বের দরিদ্র জনগণের একচতুর্থাংশের বাস এ অঞ্চলেই।
জাতিসংঘের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ বাসিন্দাই দরিদ্র। দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও রাজনৈতিক বিশ্বাস খুবই দুর্বল ফলে আন্তঃবাণিজ্যও কম। স্বাভাবিকভাবেই এর ছাপ পড়েছে পানির মতো জরুরি প্রসঙ্গেও। পানিও ক্রমে এখানে বিবাদের এক বিষয় হয়ে উঠছে। কারণ তার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ দেশের পানিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী মানসিকতাও রূঢ় রূপ নিচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অঞ্চলে পানিতে ধীরে ধীরে মানুষের অভিগম্যতা কমে আসছে। ফলে পানিযুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই আরো তীব্র হচ্ছে। পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধ-উম্মাদনা সর্বশেষ পানির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার অবধারিত এক নিয়তি এবং বাংলাদেশও এই যুদ্ধ পরিসরের বাইরে নয়। কারণ বাংলাদেশ নামক প্রিয় দেশটির রক্ত হল এই পানি। মানুষের শরীর যেমন রক্ত বিহীন অচল তেমনি পানি ব্যতীত প্রিয় দেশটিও অচল। কারণ আমাদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস কৃষি। বলা যায় ৮৫% থেকে ৯০% মানুষ সরাসরি কৃষি কাজের সাথে জড়িত। আমাদের নদীগুলোর বেশির ভাগই এসেছে হিমালয়ের গাঙ্গত্রি হিমবাহ, আসামের লুসাই, কৈলশ টিলা ইত্যাদি পর্বত মালা থেকে। ভাটির দেশ হওয়ায় এখানের মাটি খুবই উর্বর। এ কারণে কৃষি খাতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এশিয়ার গণ্ডি পার করে বিশ্বে সবজি উৎপাদনে জনবহুল বাংলাদেশ এখন তৃতীয় অবস্থানে। কেবল সবজি-ই নয় ধান উৎপাদনেও বিশ্বে আয়তনের দিক থেকে অনেক পেছনে থাকা বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, আমে সপ্তম ও আলুতে অষ্টম। তা’ই বলাযায় সঠিক ভাবে পানি প্রবাহ না থাকলে নদী থাকবে না,আর নদী না থাকলে কৃষি থাকবেনা, আর কৃষি না থাকলে আমরা…?
লেখক :: মো.আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম :: কলামিস্ট, আইনজীবী ও জিও পলিটিক্স বিশ্লেষক।