বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩২ অপরাহ্ন
ভোট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। এই ভোটের দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং জাতীর কর্নধার নির্বাচিত হয়। তাই ইসলামের দৃষ্টিতেও ভোটের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রহঃ) লিখেছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি-
(১) সাক্ষ্য প্রদান।
(২) সুপারিশ।
(৩) প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা প্রদান।
(জাওয়াহিরুল ফিকহ ৫ /৫৩৩)
.
(১) সাক্ষ্য প্রদানঃ
কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ হল। একথার সাক্ষ্য প্রদান যে, অমুক লোকটি তুলনামূলক যোগ্য এবং ভালো। কাজেই অযোগ্য লোককে ভোট দেওয়ার অর্থ হল মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। যা শরীআতের দৃষ্টিতে অনেক বড় গোনাহে কবীরা। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৫৪)
.
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন –
ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ ﻛُﻮﻧُﻮﺍ ﻗَﻮَّﺍﻣِﻴﻦَ ﺑِﺎﻟْﻘِﺴْﻂِ
ﺷُﻬَﺪَﺍﺀَ ﻟِﻠَّﻪِ
হে ঈমানদারগন তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য দান কর। (সূরা নিসা, আয়াত নং ১৩৫)
অন্যত্রে ইরশাদ হচ্ছে –
ﻭَﺃَﻗِﻴﻤُﻮﺍ ﺍﻟﺸَّﻬَﺎﺩَﺓَ ﻟِﻠَّﻪِ
তোমরা আল্লাহর ওয়াস্তে সঠিক সাক্ষ্য দান কর। (সূরা তালাক , আয়াত নং ২)
.
(২) সুপারিশঃ
ভোটের দ্বিতীয় অবস্থান হল তা সুপারিশ। অর্থাৎ কেউ কোন প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অর্থ হল সে উক্ত প্রার্থীকে নির্বাচিত হওয়ার এবং যোগ্য হওয়ার সুপারিশ করছে। আল্লাহ
তাআলা ইরশাদ করেন –
ﻣَﻦْ ﻳَﺸْﻔَﻊْ ﺷَﻔَﺎﻋَﺔً ﺣَﺴَﻨَﺔً ﻳَﻜُﻦْ ﻟَﻪُ ﻧَﺼِﻴﺐٌ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﻭَﻣَﻦْ ﻳَﺸْﻔَﻊْ ﺷَﻔَﺎﻋَﺔً ﺳَﻴِّﺌَﺔً ﻳَﻜُﻦْ ﻟَﻪُ ﻛِﻔْﻞٌ ﻣِﻨْﻬَﺎ
যে লোক সৎকাজের জন্য কোন সুপারিশ করবে তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক সুপারিশ করবে মন্দ কাজের জন্য সে তার বোঝারও একটি অংশ পাবে। (সূরা নিসা, আয়াত নং ৮৫)
.
সৎকাজের সুপারিশ হল, তুলনামূলক যোগ্য দ্বীনদার লোকের জন্য সুপারিশ করা। যে আল্লাহ এবং বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় করে। মন্দ কাজের সুপারিশ হল অযোগ্য কোন ফাসেক বা জালেমকে ভোটের মাধ্যমে জাতীর উপর বোঝা ও যন্ত্রনা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া। উপরোক্ত আয়াত স্পষ্ট বুঝে আসে যে, আমাদের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত প্রার্থী ভালো মন্দ যা কিছু করবে তা আমাদের আমল নামায় যুক্ত হবে এবং আমরাও তাতে শরীক গন্য হব।
.
(৪) প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা প্রদানঃ
ভোটের তৃতীয় আর একটি দিক হল প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা প্রদান অর্থাৎ কেমন যেন ভোটার, প্রার্থীকে জাতীর সেবার প্রতিনিধি বানাচ্ছে। আর এই প্রতিনিধিত্ব যদি ব্যক্তিবিশেষে সীমাবদ্ধ থাকে তবে তার দায়ভার ব্যক্তির উপর বর্তায়। অথচ এখানে বিষয়টি ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এখানে তার প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি পূরো জাতীর সাথে সম্পৃক্ত। কাজেই সে যখন কোন অযোগ্য জালেম পাপাচারীকে প্রতিনিধি বানাবে তথা ভোট দিবে তখন উক্ত প্রতিনিধি দ্বারা যাদের হক নষ্ট হবে, তার গোনাহের একটি অংশও তার উপর বার্তাবে।
.
ভোট দেওয়া জরুরীঃ
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভোট মূলত সাক্ষ্য দেওয়া। আর যেমনিভাবে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া হারাম তেমনিভাবে প্রয়োজনের সময় সাক্ষী গোপন কারাও হারাম। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন –
ﻭَﻟَﺎ ﺗَﻜْﺘُﻤُﻮﺍ ﺍﻟﺸَّﻬَﺎﺩَﺓَ ﻭَﻣَﻦْ ﻳَﻜْﺘُﻤْﻬَﺎ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﺁﺛِﻢٌ
ﻗَﻠْﺒُﻪُ
তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। আর যে সাক্ষ্য গোপন করে তার অন্তর গোনাহগার। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ২৮৩)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
“কাউকে সাক্ষীর জন্যে ডাকা হলে সে তা গোপন করলে তা মিথ্যা সাক্ষীর ন্যায়” (তাবারানী আওসাত ,হাদীস নং ২৭০)
অর্থাৎ ভোট না দেওয়া সাক্ষ্য গোপন করার ন্যায়, যা স্পষ্ট হারাম। কাজেই ভোট দেওয়া জরুরী।
.
এক্ষেত্রে অনেকে এমন ধ্যান -ধারনা পোষন করে যে, রাজনীতি, ভোট এগুলোতো চরম গান্ধা জিনিস। ভালো মানুষ এগুলোর সংস্পর্শে আসতে পারে না। অথচ এই ধারনার পরিনাম অত্যন্ত ভায়াবহ। যে ভয়াবহতা পুরো জাতীকে বহন করতে হয়। কেননা ভালো মানুষ যদি ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে তবে খারাপ মানুষের ভোটে খারাপ মানুষ নির্বাচিত হবে। তাহলে তো ঐ রাষ্ট্রীয় অঙ্গন চিরদিন খারাপই থেকে যাবে। এই খারাবী শুধু তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং সামগ্রীকভাবে তা অভিশাপরূপে ছাওয়ার হয়।
.
অনেকে মনে করে আমার একটি ভোটের দ্বারা কি আসে যায়? অথচ একথা সবার জানা প্রচলিত গণতন্ত্রে একটি ভোটের গুরুত্বও অনেক বেশী। যখন ভাল ও মন্দ দুই জন প্রতিদ্বন্দী সমান সমান ভোট পায় তখন মাত্র একজন ভোটারই (চাই সে সবচে নিকৃষ্ট হোক বা সবচে উত্তম) পুরো জাতীর ভাগ্য নির্ধারন করে। তারা মাযলুম, নিপিড়ীত হবে নাকি তাদের সকল অধিকার সংরক্ষিত হবে? সুতারাং একজন ভোটার বা একটি ভোট অনেক বড় ভুমিকা পালন করে।
.
তাছাড়া সমস্ত ভালো মানুষ যদি মনে করে যে, আমার একজনের ভোটের দ্বারা আর
কি হবে তাহলে তো খারাপ মানুষের রায় প্রাধান্য পাবে। এর দ্বারা সমাজের পরিবর্তন কোন দিন সম্ভব নয়। বরং প্রত্যেকে তার রায়কে (ভোটকে) প্রকাশ করে অযোগ্য ও জালেম লোকের অভিশাপ থেকে জাতীকে রেহাই দিবে। আর প্রত্যেক বিবেকসম্পন্ন লোক যদি তাদের ভোটারাধিকার যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করে তবে অযোগ্য ও জালেম লোক নির্বাচিত হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।
.
এখানে আরেকটি আপত্তি আসতে পরে যারা নির্বাচনে দাড়ায় তাদের মধ্যে তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজনও যোগ্য হয় না। এর জবাব হল যখন কারো সামনে দুটো ক্ষতির দিক আসে তখন শরীআতের মূলনীতি হল, যার মধ্যে তুলনামুলক ক্ষতি কম তা এখতিয়ার করতে হয়। কাজেই যার দ্বারা ইসলামের ক্ষতি হবে, মুসলিম উম্মাহ নির্যাতিত হবে তার বিপরীত লোককে ভোট দিয়ে তাকে প্রতিহত করতে হবে। হযরত আবু বকর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নিজে রাসূলুল্লাহ (সা) এর মুখে শুনেছিঃ
ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻨَّﺎﺱَ ﺇِﺫَﺍ ﺭَﺃَﻭُﺍ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻢَ ﻓَﻠَﻢْ ﻳَﺄْﺧُﺬُﻭﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻳَﺪَﻳْﻪِ ، ﺃَﻭْﺷَﻚَ ﺃَﻥْ ﻳَﻌُﻤَّﻬُﻢُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺑِﻌِﻘَﺎﺏ.
যদি লোকেরা জালিম ব্যক্তির জুলম (অন্যায় অত্যাচার) দেখেও তা দমন করতে চেষ্টা না করে, আল্লাহ তা’আলা সত্ত্বরই হয়তো তাদেরকেও অপরাধীদের অন্তর্ভুক্ত করে আযাবে নিক্ষেপ করবেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৩৩৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৫৩, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ২১৬৮, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৩০৫)
.
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেককে তার ভোটারাধিকার প্রয়োগ করতে হবে। আর কোন ভালো মানুষকে ভোট না দেওয়ার কারণে অযোগ্য ও জালেম লোক নির্বাচিত হয়ে খুন, গুম, যিনা, ধর্ষণ সহ বিভিন্ন ভাবে অন্যায় অত্যাচার করলে এর দায়ভার তার উপর বার্তাবে। বরং সমগ্র জাতীর যে ক্ষতি হবে এর জন্যও সে দায়ী।
.
হে অাল্লাহ ভোটের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসকের সকল জুলুম অত্যাচার কে প্রতিহত করার তৌফিক আমাদের দান কর! (আমীন)
লেখক: তানজিল ইসলাম