বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ অপরাহ্ন
মো. আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম ::
১লা এপ্রিল মুসলিম নিধনের এক কালো ইতিহাস!!প্রথমেই সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী গ্লান্ডস্টোন এর একটি বক্তব্য দিয়ে শুরু করা যাক। তার বক্তব্যটি ছিলো মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য রয়েছে দুইটি প্রক্রিয়া- এক.তাদের কাছ থেকে কুরআনকে কেড়ে নিতে হবে, কিন্তু তা সম্ভব নয়। দুই.তারা যেন কুরআনের প্রতি ভালবাসা হারিয়ে ফেলে সেই কাজ করতে হবে কৌশলে,আর তা হবে বেশি কার্যকারী।
বর্তমান ২০২১ সালে সারা পৃথিবী জুড়ে মুসলমানদের যে অবস্থা তা’তে কী মনে হতে পারে আমাদের! এবার ফেরা যাক ইতিহাসের পাতায় ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল এই দিনে, খ্রীস্টান রাজা ফার্ডিনান্ড স্পেনের মুসলিমদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মসজিদের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে লক্ষ-লক্ষ মুসলিম হত্যা করে। আজও পাশ্চাত্য জগতে প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে- “APRIL FOOL” ‘মানে’ এপ্রিলের বোকা’ উৎসব হিসাবে।
ইউরোপের সর্ব পশ্চিম উপদ্বীপ আইবেরিয়া, যা স্পেন ও পর্তুগাল দ্বারা গঠিত। এই উপদ্বীপের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত “জিব্রাল্টার”। এই নামের সাথেই জড়িত আছে ইউরোপে মুসলিমদের আগমন ও ইতিহাস। “জিব্রাল্টার” নামটি আসে মুসলিম বীর সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদ-এর নাম থেকে। মুসলিম এই বীর সেনাপতির হাত ধরেই হয় মুসলমানদের ইউরোপ বিজয়ের সূচনা।
৭১২ খ্রীস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদ ভূ-মধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে অত্যাচারী রাজা রডরিকের ১লাখ ২০হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বিজয় লাভ করে ঐতিহাসিক স্পেন জয় করেণ। এই বিজয় অর্জনের জন্য বীর সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ স্পেনের সমুদ্র তীরে অবতরণ করেই তার সব জাহাজ পুড়িয়ে ফেলেন। তখন তিনি তার সাথীদের বললেন, এখন আমাদের পশ্চাতে উত্তাল সমুদ্র আর সম্মুখে শত্রু সৈন্য। শত্রু সৈন্যদের পিছু হটিয়ে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই। এ কাজ আমরা যত দ্রুত, সাহসিকতার সাথে করবো ততই উত্তম। অলসতা, ভিরুতা ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই আনে না। স্পেনের অবতরণের পরপরই স্পেনের রাজা রডরিকের এক সেনাপতির মোকাবিলা করতে হয়। তারিক তাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে পালাতে বাধ্য করে। পরাজয়ের সংবাদ রাজা রডরিককে জাননো হলে তিনি বিপুল প্রস্তুতি নিয়ে তারিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তা’তেও তারিক জয় লাভ করেণ। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে পরবর্তী আটশত বছর মুসলমানারা স্পেনে আধিপত্য বিস্তার করে। এই সময়ে স্পেনে জ্ঞান- বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে।এর বাস্তব স্বাক্ষী গ্রানাডা,আলহামরা,টলেডো প্রভৃতি।
মুসলমানদের এই আটশত বছরের শাসনের শেষ দিকে মুসলিম শাসকেরা ভোগবিলাস এবং লোভ লালসায় জড়িয়ে পড়ে। খ্রীস্টানদের চোখে ধরা পড়ে মুসলমানদের অনৈক্য ও দুর্বলতা। ১৪৬৯ খ্রীস্টাব্দে খ্রীস্টান রাজা ফার্ডিনান্ড পর্তগীজ রাণী ইসাবেলাকে বিয়ে করে দুই বৃহৎ খ্রীস্টান শক্তি সম্মিলিত শক্তি রুপে আত্নপ্রকাশ করে। তারা স্পেনের মুসলিম সভ্যতার অস্তিত্বকে গুড়িয়ে দেয়ার শপথ নেয়। ১৪৮৩ সালে ফার্ডিনান্ড ও ইসাবেলা একটি শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী পাঠান মালাগা প্রদেশে। যাদের প্রতি নির্দেশ ছিল মুসলমানদের শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দেয়া, বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা যে অলিভ ওয়েল ব্যবহার করি তার বেশির ভাগই আশে এই স্পেন থেকে। ওলিভ গাছ অর্থাৎ সেই সময়ে মুসলমানদের জলপাই গাছ ও দ্রাক্ষা গাছ কেটে ফেলারও নির্দেশ ছিল। তার সাথে সমৃদ্ধিশালী গ্রামগুলো ধ্বংস করা এবং গবাদিপশু তুলে নেয়া। এমন এক সময়ে মৃত্যু ঘটে তখনকার মুসলিম শাসক আবুল হাসান আলীর। শাসক হন আজ জাগাল। এক পর্যায়ে প্রাণ রক্ষা ও নিরাপত্তা অঙ্গীকারের ওপর নগরীর মুসলমানরা আত্নসমার্পণ করলেও নগরী জয় করেই রাজা ফার্ডিন্যান্ড চালান গণহত্যা। দাস বানানো হয় জীবিত অধিবাসীদের।
০৪ ডিসেম্বর, ১৪৮৯ সাল। আক্রান্ত হয় বেজার নগরী।আজজাগাল শত্রুদের সাময়িক প্রতিহত করলেও এক পর্যায়ে আত্নসমার্পন করেণ। ডিসেম্বর, ১৪৯১ এ তৎকালীন স্পেনের রাজধানী গ্রানাডায় আত্নসমার্পনের শর্ত নির্ধারিত হলো। বলা হলো ছোট- বড় সকল মুসলমানের জীবনের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে।তাদের মুক্তভাবে ধর্ম কর্ম করতে দেয়া হবে। তাদের বিখ্যাত কর্ডোভা মসজিদসহ অন্যান্য মসজিদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতি নিরাপদ থাকবে। তাদের নিজেদের আইন -কানুন অনুযায়ী তাদের প্রশাসকরা তাদের শাসন করবেন। এভাবে নানান কৌশলে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের এক পর্যয়ে ১৪৯২ খ্রীস্টাব্দে গ্রানাডাবাসী আত্নসমার্পন করেন। রাণী ইসাবেলা ও রাজা ফার্ডিনান্ড এক পর্যায়ে চুক্তি লঙন করতে লাগলো।চারদিকে চালাচ্ছিল ভয়াবহ নির্যাতন। পাইকারী হারে হত্যা, বর্বরতার নির্মম শিকার হতে থাকলেন অসংখ্য মুসলমান। স্পেনের গ্রাম ও উপতক্যাগুলো পরিণত হলো মানুষের কসাইখানায়।যেসব মানুষ পর্বতগুহায় আশ্রায় নিয়েছিল, তাদেরকেও মেরে ফেলা হলো আগুনের ধোঁয়া দিয়ে।
এমতাবস্থায় ০১লা এপ্রিল,১৪৯২। ফার্দিনান্ড ঘোষণা করেছিল, যারা মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেবে তাদের নিরাপদে আশ্রয় দেওয়া হবে। তার ঘোষণায় লাখ লাখ মুসলমান আত্মবিশ্বাসী হয়ে গ্রানাডার বিভিন্ন মসজিদে আশ্রয় নিলেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। মসজিদের দরজাগুলো বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে মসজিদের মেঝেতে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে মুসলিমদের হত্যা করেছিল রাজা ফার্ডিনান্ড। ঐতিহাসিক এক বর্ণনা মতে তিন দিন পর্যন্ত হত্যাকান্ডের উৎসব চলেছিল। মসজিদের বাহিরেও অসংখ্য মুসলিমকে আগুনে পুড়িয়ে, পাহাড় থেকে ফেলে, সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ ডুবিয়ে ও গণজবাই করে হত্যা করা হয়। অনেককে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। অথচ মুসলমানরা এ রকম একটি অবস্থার জন্য প্রস্তুত না থাকায় তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেদিন খ্রিস্টানগুরুর আদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সূত্র লক্ষ লক্ষ আরবি পুস্তক পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। শুধু মুসলিমগণ নয়, ইয়াহুদীদের উপরও খ্রিস্টানগণ একই রূপ অত্যাচার করে। মুসলমানদের লাশ পোড়া গন্ধে আভিভূত হয়ে রাজা হাসলেন এবং রাজা ফার্ডিনান্ড উপহাস করে বলেছিল, হায় মুসলমান! তোমরা হলে এপ্রিলের বোকা ( এপ্রিল ফুল)। মুসলিমদের মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে বোকা বানানোর সময়কে স্মরণীয় করে রাখতে এপ্রিল ফুল পালন করা হয়।
অবশেষে খ্রিস্টানরা কর্ডোভার সেই ঐতিহাসিক মসজিদটিকে গীর্জায় পরিণত করেছে। মসজিদের ভেতরে দরজা ও জানালার ফাঁকে ফাঁকে মূর্তি স্থাপন করেছে। এভাবেই মুসলিম ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হয়েছে। এই গণহত্যার পরেও যেসব মুসলমান আন্দালুসিয়ায় রয়ে গিয়েছিল,তাদের ফার্ডিনান্ডের পুত্র তৃতীয় ফিলিপ সহায় সম্বলহীনভাবে জাহাজে করে সমুদ্র পথে নির্বাসিত করেণ। এদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখেরও বেশি। ইতিহাস থেকে জানা যায়,তাদের অল্প সংখ্যক লোকই জীবিত ছিলেন। বিপুল সংখ্যক মুসলমান সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। হায়রে নির্মমতা! বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও আমরা মুসলিমরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চরিত্র, ধর্ম ও সংস্কৃতি সবকিছুই যেন ভুলে গেছি! মুসলিম হিসেবে কী করণীয় তা খুঁজে দেখি না। এক কথায় বিবেকের দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। এক রকম সঠিক জ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে ভ্রান্ত অনুকরণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। তার একটি দৃষ্টান্ত হলো ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন করা।
তাহলে আমরা সবাই মিলে একসাথে জোড়ে বলি ” এপ্রিল ফুল ইস নট মুসলিম ট্রেডিশন”
তথ্যসূত্র: (১) এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
(২) উইকিপিডিয়া
(৩) বিভিন্ন ধরণের ইতিহাস গ্রন্থ
লেখক :: মো.আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম :: কলামিস্ট, আইনজীবী ও জিও পলিটিক্স বিশ্লেষক।