বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৭ অপরাহ্ন
বিজ্ঞান ও ধর্ম পরস্পরের প্রতি অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে আরো বেশি উগ্র হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। কট্টর ধর্মবিশ্বাসে যেখানে বিজ্ঞানকে বিপথে চালিত বা তথ্যের দূষিত উৎস বলে দেখা হচ্ছে সেখানে ধর্ম শুধু ভুল বা অর্থহীনই নয়, বিপজ্জনকও বটে বলে তর্কপ্রবণ বিজ্ঞানীদের যুক্তি বাদানুবাদের সৃষ্টি করেছে।
আমি ধর্মের পক্ষে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী নই। একজন মনস্তত্ত্ববিদ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মানুষের গোপন স্বভাবকে উন্মুক্ত করার সবচেয়ে ভালো হাতিয়ার। কিন্তু আমাদের মন কীভাবে কাজ করে তা বোঝার কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় আমি চিন্তিত হয়ে পড়তে শুরু করি এজন্য যে ধর্মীয় ও বিজ্ঞানমনা সম্প্রদায়ের মধ্যেকার বিভক্তি শুধু অপ্রয়োজনীয় শত্রুতার ইন্ধনই যোগাচ্ছে না, তা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রক্রিয়াকেও ধীর করছে।
মানুষ কী রকম এবং তারা কীভাবে তাদের গভীরতম নৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে, ধর্মীয় ঐতিহ্য সে বিষয়ে বিপুল ভাবনার রসদ যোগায়। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ নিজেদের আচরণ, অন্য লোকদের সাথে সহাবস্থান, কীভাবে অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করা যায় ও জীবনের পূর্ণতা লাভের নির্দেশনা এবং বহু রকম বাধার মধ্যে এসব বিষয় সম্পন্ন করতে আধ্যাত্মিক নেতা ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দিকে ফিরেছে। ধর্মের এক কট্টর সমালোচক প্রাণিবিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স বলেছেন যে, ধর্মতাত্তি¡কদের কথা শোনা ও তাদের সাথে বিতর্ক করার সময় তিনি কখনোই তাদের মধ্যে সামান্যতম সহনীয়তা দেখেননি। তা সত্তে¡ও এটা মনে করা ঠিক নয় যে, ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ যারা মানুষের মন নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী কাজ করেছেন, তারা মানব আচরণ বিষয়ে সমীক্ষার জন্য বৈজ্ঞানিকদের আগ্রহ সৃষ্টি করার মত কিছু আবিষ্কার করেননি।
প্রাচীনেরা সব সময় বিচক্ষণতার পরিচয় দেননি, তার মানে এ নয় যে, তারা সব কিছুতেই বোকামির পরিচয় দিয়েছেন। ঘটনা কী তা নির্ধারণে একমাত্র হাইপোথিসিস ধারণা কাজে লাগানো যায়। আমার নিজের কাজে বারবার সে রকম করেছি। মানুষের আচরণ বিষয়ে ধর্মের এসব ধারণা ও কীভাবে তা প্রভাবিত হয় তা আমি দেখেছি। কখনো অন্ধভাবে তা গ্রহণ না করলেও কোনো কোনো সময় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার দ্বারা তা খন্ডন হতে দেখা গেছে।
মানুষের ধর্মীয় পন্থায় সম্পৃক্ত হওয়ার চ্যালেঞ্জটি বিবেচনা করুন। প্রত্যেক ধর্মেই এর ব্যবস্থা আছে। যেমন বৌদ্ধ ধর্মে আছে ধ্যান যা মানুষের কষ্ট হ্রাস ও নৈতিক আচরণকে শক্তিশালী করে। আমার ও অন্যদের গবেষণায়ও এটা নিশ্চিত যে, এটা ঠিক তাই করে, এমনকি ধ্যান যখন ধর্মনিরপেক্ষ প্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রদান ও পালন করা হয়, তখনও। এ বিষয়টি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তাদের প্রতি অনুকম্পার সৃষ্টি করে এ বিবেচনায় যে কষ্ট ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়েও তারা প্রতিশোধ নেয়ার কথা বিস্মৃত হন।
আরেকটি ধর্মীয় পন্থা হচ্ছে ক্রিয়া পদ্ধতি। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পুনরাবৃত্তিমূলক কার্যক্রম বা সম্মিলিত পন্থা বা সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া। গবেষণায় দেখা যায় যে, ক্রিয়াপদ্ধতিগত কর্মকান্ড, এমনকি তা ধর্মীয় প্রেক্ষিত বহির্ভূত হলেও তা মনের উপর প্রভাব ফেলে যা আত্মনিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি থেকে বৃহত্তর সম্পৃক্তি ও সহানুভূতির অনুভূতি সৃষ্টি করে।
ক্রিয়া পদ্ধতি ধর্মবিশ্বাস শক্তিশালী করার একটি অংশ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। জ্ঞানীয় অনৈক্য বিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, প্রকাশ্যে বিবৃত বিশ্বাস যা আমরা প্রাথমিকভাবে অনুমোদন করি না তা এক মনস্তাত্তি¡ক উত্তেজনার সৃষ্টি করে যা প্রকাশ্য ঘোষণার সাথে সঙ্গতি রাখার জন্য প্রায়ই পরিবর্তন ঘটিয়ে ত্রুটিমুক্ত করা হয়। এভাবে প্রকাশ্যে বিবৃত বিশ্বাস বারবার পরিবর্তনের ধর্মীয় আচার ক্যাথলিক ধর্মে প্রার্থনার অংশ হিসেবে ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা জোরদার করতে পারে।
রেডিও শো ‘অন বিং’-এর উপস্থাপিকা ক্রিস্টা টিপেট-এর কথায় এ ধরনের অনুসন্ধান যা বলে তা হচ্ছে ধর্মে কৌশল বা আধ্যাত্মিক প্রযুক্তি রয়েছে যা মানুষকে বিপদ সহ্য করতে, মত পরিবর্তন করতে বা পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে এগোতে সাহায্য করে। এসব কৌশল অবচেতনভাবে আমাদের আচরণকে নাড়া দিয়ে কাজ করে। টিপেট জোর দিয়ে বলেন যে, সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে এই কৌশল ধার করা, তাকে তার নিজ পদ্ধতিতে বুঝা ও সম্মান করা উচিত। কিন্তু সম্প্রতি আমি যখন তার সাথে সাক্ষাত করি, তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, এই কৌশল তাদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কাজ করতে পারে, যেমনটি ধ্যান ও অন্যান্য ধর্র্মীয় রীতির ক্ষেত্রে দেখা গেছে।
এ মত যদি সত্য হয় তাহলে ধর্ম নেশার বিরুদ্ধে লড়াই, ব্যায়াম বৃদ্ধি, অর্থ সঞ্চয় ও অভাবী মানুষদের সাহায্য করতে মানুষকে উৎসাহিত করার মত বহু বিষয়ে সহায়তা করতে পারে। অন্যদিকে কৃতজ্ঞতা ও দয়ার মত ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সৎকর্মের চর্চা দ্বারা মানুষ তাদের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সাফল্যের মত ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষমতা উন্নত করতে পারে।
এ গবেষণার বিষয়ে আমি জ্ঞানীয় বিজ্ঞানী ও ধর্মীয় সন্দেহবাদী স্টিভেন পিংকারের সাথে আলোচনা করলে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, এটা কোনোভাবেই সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস খন্ডন নয়। তিনি তার ভাষায় ধর্মীয় কর্মকান্ড ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শনের জন্য একটি যুক্তির উল্লেখ করেন।
আমি যদি অধ্যাপক পিংকারের যুক্তি দেখি ও তার সাথে একমত হই যে, সামগ্রিকভাবে ধর্মকে অশ্যই তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফলাফলের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে, তাহলে সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যেকার বিভেদ রেখাটি ঝাপসা হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ ইহুদিদের সাবাথ পালনের কথা বলা যায়। ঐশী নির্দেশ অনুযায়ী এ দিনটি হচ্ছে বিশ্রামের যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ধর্মীয় ক্রিয়া পদ্ধতি ও প্রার্থনা। কিন্তু একই সাথে তা একটি সাংস্কৃতিক আচারও বটে যাতে লোকজন পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য বিষয়ের দিকে নজর দিতে পারে।
ধর্ম খারাপ বা ভালো সে যুক্তি দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। অধিকাংশ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মত এর মূল্য নির্ভর করে যারা এটা ব্যবহার করছে তাদের মনোভাবের উপর। কিন্তু অবিচার প্রসূত সামাজিক আধিপত্যের ন্যায্যতা দিতে বা মিথ্যা বিশ্বাসকে লালনে উৎসাহিত করতে যে সকল ঘটনায় আন্তগ্রুপ সংঘাতে উস্কানি দিতে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে তা সমীক্ষায় দেখা যায় যে, কীভাবে তা হীন উদ্দেশ্য সাধনে মনের কৌশলগত সুবিধার আশ্রয় নিতে আমাদের ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। অন্তর্দৃষ্টি হচ্ছে সে বিষয় যা বোঝা এবং তারপর ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাচারের মোকাবেলার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে তা সে ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি যার দ্বারাই সম্পন্ন হোক না কেন।
বিজ্ঞান ও ধর্মের কার্যক্রমের জন্য একের অপরের প্রয়োজন নেই, কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে তারা এক অপরের দ্বারা উপকৃত হবে না। বিজ্ঞান ও ধর্মীয় জগতের মধ্যে যে সংগঠনটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে চায় সেই সিনাই অ্যান্ড সাইনাপসেস-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাব্বি জিওফ্রে মিটেলম্যান আমাকে সম্প্রতি বলেন যে বিজ্ঞান ধর্মগুরুদের তাদের চেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারবে যাদের তারা মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনে সামাজিক ও আচরণিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলছেন।
কিছু মহলের মধ্যে ধর্ম-বিজ্ঞানের সম্মিলনের একটি আকুল আকাক্সক্ষা ক্রমবর্ধমান। ক্রিস্টা টিপেট একটি সহস্রাব্দ গ্রুপ কর্তৃক প্রণীত ফরমেশন প্রজেক্ট নামক একটি উদ্যোগকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যারা প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য রীতির সাথে মনস্তত্ত¡ ও নিউরোসায়েন্সের ধারণা সমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ জীবন ব্যবস্থা ও সমাজ গড়ার কথা ভাবছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, এটা করে এই তরুণের দল অন্ধভাবে কোনো মতবাদকে গ্রহণ করছে না। তারা প্রশ্ন করছে এবং প্রমাণ ভিত্তিক কাজগুলোকেই বেছে নিচ্ছে। সংক্ষেপে, তারা সেটাই করছে যা বিজ্ঞানী ও ধর্মগুরুদের আরো জোরালোভাবে ও বৃহত্তর পর্যায়ে করা প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি।
এটা কী কাজ করবে? এ এক পরীক্ষামূলক প্রশ্ন। কিন্তু আমরা যদি একটা অনুসন্ধান করতে না চাই তাহলে কোনোদিনই জানতে পারব না। আমার সন্দেহ, এর জন্য আমরাই দরিদ্র হব।
*এ নিবন্ধের লেখক ডেভিড দ্যস্টেনো যুক্তরাষ্ট্রের নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্তে¡র অধ্যাপক। তিনি ‘ইমোশনাল সাকসেস ঃ দি পাওয়ার অব গ্র্যাটিচিউড, কমপ্যাশন অ্যান্ড প্রাইড’ গ্রন্থের রচয়িতা।