বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৮ অপরাহ্ন
মো. আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম::
মানবসভ্যতার ঊষালগ্নে ব্যাবিলন নগরীর কাছাকাছি এক দরিদ্র পল্লীতে বসবাস করতেন সুজানা। তার রূপযৌবন পুরুষদের মাথা ঘুরিয়ে দিত। তার সততা এবং উত্তম চরিত্রের কাহিনী মানব ইতিহাসের কিংবদন্তি উপাখ্যান হিসাবে পবিত্র বাইবেলে স্থান পেয়েছে। তার জীবনের একটি নির্মম ঘটনার ভিত্তি করেই বিচার ব্যবস্থায় ওকালতি এবং ফৌজদারি বিচারে সাক্ষ্যগ্রহণের রীতি প্রবর্তিত হয়েছে।
স্বামী, পিতা-মাতা ও আত্নীয়স্বজনকে নিয়ে অত্যন্ত সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। সাধারণ দরিদ্র হওয়া সত্তেও অসাধারণ রূপ লাবণ্য এবং সততা, কর্মনিষ্ঠা ও উত্তম চরিত্রের জন্য তিনি পুরো ব্যবিলন শহরতো বটেই আশপাশের শহর বন্দর এবং নগরীর অধিবাসীদের কাছে মশহুর ছিলেন। ব্যবিলন তখন অসিরীয় সম্রাট নেবুচাঁদনেজার অধীনে শাসিত হচ্ছিল। সিরিয়া, ইরাক, জেরুজালেমসহ বিস্তীর্ন এলাকায় তখন কেন্দ্রীয় শাসন চললেও সম্রাট পুরো সাম্রাজ্যের স্থানীয় শাসন চালানোর জন্য আজকের জমানার পঞ্চায়েত, ইউনিয়ন পরিষদ বা কাউন্টির মতো ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে মুরব্বিদের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন, যাকে বলা হত কাউন্সিল অব এল্ডার্স। এরা এলাকার রাজস্ব আদায়, পুলিশি ব্যবস্থা তদারক এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা সমূহের নিষ্পত্তি করতেন।
সুজানাদের গ্রামের কাউন্সিল অব এল্ডার্সের সদস্য ছিলেন দুজন বয়স্ক মানুষ, যাদের কুকর্মের কারনেই বাইবেলে সুজানার কাহিনি ঠাই পেয়েছে। সুজানার অপরূপ রূপ লাবাণ্য দেখে আলোচিত দুই বৃদ্ধ প্রবলভাবে কামাতুর হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয় ফেলেন। একদিন সুজানা কাজের মেয়েটিকে নিয়ে গোসল করছিলেন। হঠাত্ কি মনে করে তিনি কাজের মেয়েটিকে বাড়ি থেকে তেল নিয়ে আশার জন্য নির্দেশ দিলেন। সুযোগ বুঝে বৃদ্ধরা তাকে খারাব প্রস্তাব দিলে সুজানা তা প্রত্যাখান করলে তাকে দেখে নেয়ার হুমকি প্রদান করেন। কাউন্সিল অব এল্ডার্স তাদের নিজেদের আদালতে সুজানার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ এনে নিজেরাই স্বাক্ষী সেজে প্রকাশ্যে পাথর মেরে হত্যার সাজা ঘোষণা করল। সুজানার রায় কার্যকর করার জন্য বৃদ্ধদ্বয় ব্যাপক লোকসমাগম করলেন।
আগেই বলেছি যে, সুজানাকে সবাই সত্ চরিত্রের ধার্মিক মহিলা হিসাবেই জানত। কিন্তু তার বিপদের সময় কেউ মুখ খুলল না, বরং মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সময় যদি কিঞ্চিত্ পরিমান হলেও তার সৌন্দর্যময় উলঙ্গ শরীর দেখার সুযোগ পাওয়া যায় এমন লোভ অনেককে পেয়ে বসল। জনতার উল্লাস ধ্বনীর মাঝে দিনিয়েল নামের জনৈক যুবক চিত্কার করে বলল আমি বিশ্বাস করিনা সুজানা এমটি করেছেন এবং বৃদ্ধারা সঠিক বলেছেন। ঘটনার আকস্মিতায় জনতার উল্লাসধ্বনি থেমে গেল। জনগন বলল দানিয়েল তুমি কি করতে চাও? সে বলল আমি সম্মানিত দুজন বৃদ্ধাকে আলাদা করে আপনাদের সামনে দুটি প্রশ্ন করতে চাই। জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে তাকে স্বাগত জানাল।
প্রথম বৃদ্ধাকে দানিয়েল প্রশ্ন করলেন তিনি কখন এবং কোথায় সুজানাকে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখেছেন? উত্তরে বৃদ্ধ জানালেন তিনি চাঁদনী রাতে একটি গাছের নিচে সুজানাকে অপকর্ম করতে দেখেছেন। এরপরে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে একই প্রশ্ন করা হলে সে উত্তরে জানালেন যে, দিনের আলোতে ফসলের মাঠে অপকর্মটি হয়েছিল। উপস্থিত জনতা ক্ষোভ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। এখন তারাই দুই বিচারকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য চিত্কার শুরু করল। ফলে দুই চরিত্রহীন এবং লম্পট বৃদ্ধের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষ্যগ্রহণের পদ্ধতি। তাহলে আমাদের বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে …….?
লেখক : মো. আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা।