দলের মনোনয়ন পেলেই জয়—এমন মনোভাবের কারণে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত প্রতি আসনের বিপরীতে গড়ে ১০ জন করে দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা প্রতি আসনে ১৬-১৭ জনে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, অন্যবারের তুলনায় এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি অনেক বেড়ে গেছে। অবশ্য বেশি সংখ্যায় মনোনয়ন ফরম বিক্রি হোক, সেটা আওয়ামী লীগও চাইছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত শুক্রবার থেকে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয় থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হয়। গতকাল রাতে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তখন পর্যন্ত ৩ হাজার ২০০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধীরা অংশ নেয়নি। সেবারও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ফরম কেনার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সেবার ১৪৭ আসনে ভোট হয়। দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয় প্রায় আড়াই হাজার।
বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদদের বাইরে এবার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। যাঁদের বড় অংশ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। ব্যবসায়ীও আছেন অনেকে। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপ্রাপ্তির এই দৌড়ে দলের লোকজনের পাশাপাশি ক্রীড়াবিদ, অভিনয়শিল্পী, সামরিক-বেসামরিক সাবেক আমলারাও আছেন। আজ ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা ও নায়ক ফেরদৌস মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারেন।
দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা দুজন সাবেক ছাত্রনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এবার বিপুল পরিমাণে মন্ত্রী-সাংসদ বাদ পড়বেন—এমন আলোচনা আছে। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না, এ নিয়েও সংশয় আছে। ২০১৪ সালে অনেক অখ্যাত ব্যক্তি সাংসদ বনে গেছেন। দীর্ঘদিন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, দল টানা ১০ বছর ক্ষমতায়। এখনই নিজেকে উপস্থাপন করার সেরা সময়। মনোনয়ন পেলে জয়ের সম্ভাবনাও বেশি। আর না পেলেও ভবিষ্যতে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।
চট্টগ্রাম বিভাগের এক তরুণ ব্যবসায়ী বলেন, ইতিমধ্যে এলাকায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছেন। ৩০ হাজার টাকার মনোনয়ন ফরম কেনা তো বিষয়ই নয়। এবার না পেলেও আগামীর জন্য বিনিয়োগ করে রাখছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আজ রোববার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও কত দিন মনোনয়ন ফরম বিক্রি হবে, কবে প্রার্থী বাছাইয়ে বৈঠক শুরু হবে, কার সই করা চিঠিতে প্রার্থী চূড়ান্ত হবে—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এরপর তৃণমূল পর্যায় থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামের তালিকা চাওয়া হবে। জোট ও মিত্র দলগুলোকে কোন কোন আসন ছাড় দেওয়া হবে, সেই তালিকা হবে। এরপর দলীয় প্রধানের করার জরিপ-সমীক্ষা দেখে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
দুশ্চিন্তা অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত হয়। চেয়ারম্যান ও মেয়র পদে দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য নেতাদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন—স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেই মনোনয়ন নিয়ে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে একতরফা। এতেও ৬১ জেলায় ৭০১ জন দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে যত স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়েছে, সব কটিতেই প্রার্থীর ছড়াছড়ি দেখা গেছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘাতেই শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে আওয়ামী লীগে। এ জন্য বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও ১৪–দলীয় জোট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ নিজেদের দলে বিদ্রোহী ঠেকাতে এবং নির্বাচনের আবহ আনতে বিপুলসংখ্যক নেতাকে মনোনয়ন সংগ্রহ করতে উৎসাহ দিচ্ছে। আবার গতবারের মতো এবারও যদিও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে না আসে, সে ক্ষেত্রে যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে জন্য শরিকদের বিকল্প প্রার্থী রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দলের অন্যতম মুখপাত্র মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, দলের যে কেউ মনোনয়ন আশা করতেই পারেন। এ জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে তাঁরা কাউকে নিরুৎসাহিত করতে চান না। তবে মনোনয়ন দেওয়া হবে খুব যাচাই-বাছাই করে, সেটা আগ্রহীরাও জানেন। এরপরও রাজনীতিতে যুক্ত সবারই প্রত্যাশা থাকে, এ জন্য ফরম সংগ্রহ করে শান্তি অনুভব করেন।
মনোনয়ন বিক্রি বৃদ্ধির সাত কারণ
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ার পেছনে মোটাদাগে সাতটি কারণ জানা গেছে। এর মধ্যে তিনটি কারণ মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দিক থেকে। চারটি কারণ দলের নির্বাচনী কৌশলের অংশ।
আগ্রহীদের দিক থেকে কারণ হচ্ছে: ১. অনেকেরই ধারণা, এবারও একতরফা নির্বাচন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দলের মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত। ২. কেউ কেউ মনে করছেন, মনোনয়ন ফরম কেনাটাও একটা বিনিয়োগ। ভবিষ্যতে দলের পদ পাওয়া কিংবা সরকার গঠনের পর সুযোগ-সুবিধা পেতে এটা সহায়ক হবে। ৩. দলীয় ফরম সংগ্রহ করা সবাইকেই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মনোনয়ন বোর্ডে সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। সাবেক ছাত্রনেতাদের অনেকের মূল লক্ষ্য সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া এবং এর মাধ্যমে দলীয় প্রধানের নজরে থাকার চেষ্টা।
দলের দিক থেকে বেশিসংখ্যক মনোনয়ন ফরম কেনার উৎসাহ দেওয়ার পেছনে চার কারণ রয়েছে। এক, দলীয় ফরম সংগ্রহ করলে বিদ্রোহী হওয়ার প্রবণতা কমবে। কারণ, সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন অনুযায়ী, দলীয় ফরম সংগ্রহ করা সবাই ওই দলের প্রার্থী হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে পারবেন। পরে চূড়ান্তভাবে একজনকে মনোনয়ন দিয়ে তাঁর নামে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের চিঠি দেওয়া হবে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে। তখন ওই দলের অন্যদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাবে। তখন তাঁরা আর স্বতন্ত্র প্রার্থীও হতে পারবেন না।
দুই, ভোটে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের অনিশ্চয়তার মধ্যে সারা দেশে নির্বাচনী আবহ সৃষ্টি করার জন্যও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করার জন্য নেতাদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। দুদিন ধরে ধানমন্ডি ও এর আশপাশে মিছিল, ঢাকঢোলের আওয়াজে মাতিয়ে রাখছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাঁদের প্রচারণা চলছে।
তিন. আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কোন্দল একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদকে নিজ নিজ এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন স্থানীয় নেতারা। তাঁদের অনেকে নিজেদের বঞ্চিত মনে করেন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের অনেকের এখন দলে পদ-পদবি নেই। এঁদের উজ্জীবিত রাখার একটা উপলক্ষ এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া।
চার. দলের আয় বৃদ্ধি। এবার প্রতিটি ফরমের মূল্য ধরা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এই খাত থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।