বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৮ অপরাহ্ন
মো. আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম ::
রহমত, বরকত, মাগফিরাত তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস সাওম বা রমাদান। পবিত্র রমাদান আমাদের মাঝ থেকে বিদয়ের পথে প্রায়।
প্রতিদিন সাহরি-ইফতারি ও তারাবির মাধ্যমে পালন করছি শ্রেষ্ঠ এই দিনগুলো। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ, প্রত্যেক মুসলিম নর নারীর ওপর সাওম বা রোজাকে ফরজ করা হয়েছে এবং একই সাথে যদি কেউ অসুস্থ অথবা সফর বা ভ্রমণে থাকেন তাহলে পরবর্তীতে পালনের সুযোগও রয়েছে। আল্লাহর এই বিধান পালনের ব্যাপারে আমরা কেউ থাকি খুবই তৎপর, আবার কেউ নানান শারীরিক সমস্যা দেখিয়ে এর থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করি, যদিও একবারে অক্ষম ব্যক্তির ব্যাপারে শরীয়তে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ধর্মীয় বাধ্যবাদকতার কথা বাদই দিলাম যদি শারীরিক উপকারীতার কথাও ভাল ভাবে জানতাম তাহলে রোজা রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। প্রথমে কোরআন ও হাদিসে সাওম বা রোজার বিধান সম্পর্কে জেনে নেই এর পরে রোজা রাখলে শারীরিক এমন কি উপকারিতা রয়েছে যে উপকারীতার কথা প্রমাণ করে জাপানি বিজ্ঞানি ও অটোফেজি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিল! সে সম্পর্কে জানব-
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্যে সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহ ভীরুতা অবলম্বন করতে পারো। (সূরা বাকারাহ-১৮৩)
২) সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। যাদের জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক হয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া-একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা তা জানতে। (সূরা বাকারাহ-১৮৪)
আল্লাহ তা’য়ালা প্রথমে সাওম সম্পর্কে জানিয়েছেন,।রাখলে কি উপকারীতা তা বলেছেন এবং পুরস্কার জানিয়েছেন তার পরেও যদি সাওম বা রোজা পালন না করি তাহলে তিনি তার প্রিয় বান্দাদের কল্যাণে সরাসরি সাওম পালনের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ
দিয়েছেন …সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫) এ আয়াতের মাধ্যমেই মূলত রোজা রাখা যে ফরজ তা সাব্যস্ত হয়েছে। হাসিস এর ভাষ্য সিয়াম সম্পর্কে- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সো:) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও পর্যালোচনাসহ রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুণাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী: ৩৮, সহীহ মুসলিম: ৭৬০)
এবার আসি রমজানের শারীরিক উপকারীতার বিষয় নিয়ে ১৪০০ বছর আগে মুসলিম সমাজে রোজা রাখার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল, যা কিনা একই সঙ্গে বিজ্ঞাননির্ভর, স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসিক প্রশান্তির আধার। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সঙ্গে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রোজা রাখার অভ্যাসে উচ্চ রক্তচাপ, নানা ধরনের হৃদ্রোগবিষয়ক জটিলতা দূর হয়। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ও ইতিবাচকভাবে জীবনদর্শনেও রোজা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এবার দেখা যাক সাওম বা রোজা রাখলে আমাদের শরীরে কী ঘটে?
রোজার সময় খাবার গ্রহণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে। এতে আমাদের কোষে বাহির থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে। চিকিৎসা শাস্ত্রে এই পরিস্থিতিকে বলা হয়েছে অটোফেজি। রোজা নিয়ে বিস্ময়কর ‘অটোফেজি’ তথ্য দিয়ে ২০১৬ সালে নোবেল পেয়েছিলেন জাপানি বিজ্ঞানী ও অটোফেজি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন জীবদেহ কিভাবে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষা করে এবং কোষ কীভাবে নিজের আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করে সুস্থ থাকে, সেই রহস্য বের করার কারণে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এ বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের ভাষায় এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অটোফেজি। আর যে জিনটি এই অটোফেজি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সেটি শনাক্ত করেছিলেন টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এ অধ্যাপক। ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম দেখতে পান, কোষ কীভাবে নিজের ভেতরে একটি বস্তার মতো ঝিল্লি তৈরি করে নিজের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদানকে তার ভেতরে আটকে ফেলে। বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডে ১৯৭৪ সালে এ লাইসোজম আবিষ্কারের কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে সেখানে ঠিক কী ঘটে সেটা তখন বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি পৃথিবীতে সর্ব প্রথম অটোফেজি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি লক্ষ্য করেন লাইসোজম শুধু দেহের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদান জমা করে রাখে না। এটা রিসাইক্লিং চেম্বার বা নবায়নযোগ্য শক্তিব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে নতুন উপাদান/কোষ তৈরি করে। ইউশিনোরি দেখিয়েছেন, কোষেরা নিজেরাই নিজেদের বর্জিতাংশ বা আবর্জনাকে আটকায়। এরপর সেখান থেকে উপকারী উপাদানগুলোকে ছেঁকে আলাদা করে ফেলে। তারপর ওই দরকারি উপাদানগুলো দিয়ে উৎপাদন করে শক্তি কিংবা গড়ে তোলে নতুন নতুন অনেক কোষ। অটোফেজি প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীরে কী বৈচিত্র ঘটনা ঘটে সত্যিই অবাক হবার মত! তাহলে অটোফেজির উপকারীতা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-
অটোফেজির উপকার
১. প্রদাহ (ব্যথা, লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া এবং সংক্রমণ) কমে যাওয়া
রোগের একটা বড় কারণই প্রদাহ। ক্যান্সার, হৃদরোগ বা অন্যান্য ক্রনিক রোগের মূল কারণের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব- দেহে যখন স্থায়ীভাবে দীর্ঘসময় ধরে এ জাতীয় প্রদাহ বিরাজ করে, তখনই তা এসব রোগের রূপ নেয়। কাজেই প্রদাহ যদি কমে যায়, তাহলে রোগবালাইও হবে না!
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
এ নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলেন ডা. লোঙ্গো। সে গবেষণায় তিনি দেখান যে, কেউ যদি একটানা চারদিন উপবাস করে (পানি ছাড়া অন্য আর কিছু না খাওয়া), তাহলে তার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাটাই পুরো নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার, কারণ বহু মানুষ আছে যারা শুধু রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই ভুগছে।
৩. বার্ধক্য প্রতিরোধ
অটোফেজির কারণে ত্বক বার্ধক্যের প্রভাবমুক্ত হয় এবং ত্বককে দেখায় স্বাস্থ্যজ্জ্বল। ত্বকের ভাঁজ নিয়ে আমরা অনেক সময় দুঃশ্চিন্তা করি। বিশেষ করে ওজন কমানোর একটা সমস্যা হলো ত্বকে ভাঁজ পড়ে যায়। কিন্তু অটোফেজিকে সক্রিয় হতে দিলে এই ভাঁজের সমস্যা দূর করা সম্ভব।
৪. ক্ষুরধার মস্তিষ্ক
সক্রিয় অটোফেজি ব্যবস্থা আপনার মস্তিষ্ককে ক্ষুরধার হতেও সাহায্য করে। এমনকি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষণা থেকে দেখা যায়- আলঝেইমার বা পার্কিনসন্স জাতীয় বয়সজনিত রোগগুলো যে কারণে হয়, তার প্রতিরোধও করে অটোফেজি।
৫. জীবাণু ধ্বংস
প্যাথোজেন, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি জীবাণুকে ধ্বংস করে দেহকে সুস্থ রাখে অটোফেজি
৬. দীর্ঘ জীবন
আর এসবকিছুর মিলিত ফল হলো আপনার দীর্ঘজীবন। মানে আপনার যদি প্রদাহ কমে যায়, ক্যান্সার, হৃদরোগ না হয় তাহলে আপনার সুস্থ দীর্ঘজীবন হবে সেটাই স্বাভাবিক না?
৭. অটোফেজি ও ক্যান্সার
ক্যান্সার নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন এমন একজন বিজ্ঞানী টমাস সেফ্রেইড। প্রাকৃতিকভাবে ক্যান্সার প্রতিরোধ নিয়েই তার গবেষণা। তিনি দেখেন, বছরে কেউ যদি অন্তত একবারও সাত দিন একটানা উপবাসে থাকতে পারে (পানি ছাড়া অন্যকিছু না খেয়ে), দেহ পরিচ্ছন্ন হবার জন্যে তার আর কিছুই লাগে না। ভবিষ্যতে ক্যান্সার ঘটাতে পারে এমন সেলগুলো এ প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি এটা সাত দিন না হয়ে চারদিনও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বছরে কয়েকবার উপবাস করতে হবে।
তা’হলে এটাই প্রতিয়মান হচ্ছে, নিজের সুস্থতার জন্য হলেও রোজা রাখা প্রয়োজন। একই সাথে সর্বশক্তিমান প্রভুর পক্ষ থেকে তাকওয়ার সাথে রোজা পালনকারীর জন্যতো রয়েছে VIP গেইট রাইয়ান দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে প্রবেশের সম্মান জনক সুযোগ। স্রষ্টার কাছে আমাদের প্রার্থনা হোক তিনি যেন আমাদের অতীতের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোজা সহ সকল ফরজ ও অন্যান্য ইবাদত পালনের মাধ্যমে তা’র নগন্য গোলাম হওয়ার সুযোগ করে দেন, আমিন।
লেখক :: মো.আব্দুল্লাহ আল কাইয়ুম :: কলামিস্ট, আইনজীবী ও জিও পলিটিক্স বিশ্লেষক।