বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৪ অপরাহ্ন
আব্দুল ওয়াদুদ নোমান ::
১৭ অক্টোবর, রবিবার। সুনামগঞ্জ শহরের রোজগার্ডেন রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সেরে বলতে গেলে সেই রকম প্ল্যান-প্রোগ্রাম ছাড়াই সফর শুরু করলাম আমরা তিনবন্ধু। বন্ধুবর আব্দুল্লাহ মাহমুদ, হা. সাজ্জাদ ও আমি। নতুন ব্রিজ পাড় হয়ে আমি জানতে চাইলাম আজ কোথায় কোথায় যাওয়া যায়? সঙ্গী দুজন বললো, আরে চলেন। চলতে চলতে দেখি কোথায় কোথায় যাওয়া যায়!
যেহেতু এইদিকে আমার কোনোদিন যাওয়া হয় নাই। পথঘাট একদমই অচেনা। তাই তাদের ওপর নির্ভর করেই চুপচাপ থাকলাম। দেখি তারা কোথায় নিয়ে যায়। তো আলহামদুলিল্লাহ, তারা দৃষ্টিনন্দন ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায়ই নিয়ে গেছে আমাকে। বেশ ভালো লেগেছে সেদিনের ঘোরাঘুরিটা। সেদিন আমরা যা দেখছি, যা ভাবছি তা সোজাসুজি শেয়ার করছি আপনাদের সাথে।
যা দেখছি-১
যাদুকাটা নদী। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নেমে এসেছে এই নদী। নদীর গভীরতা কম। যাদুকাটার স্বচ্ছ জলে নিচের বালুকণা পর্যন্ত দেখা যায়। দেশের অন্যতম বৃহৎ বালুর খোয়ারী এখানে। এখান থেকে উত্তোলন করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বালু পাঠানো হয়। শতশত মেশিনের আওয়াজে পুরাটা এলাকা থাকে থমথমে। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বালু তোলায় ব্যস্ত হাজার হাজার মানুষ। বালু তোলার এ দৃশ্য আসলেই অন্যরকম। যেহেতু এই দৃশ্য এর আগে আর কখনো দেখিনি, তাই ভীষণ ভালো লাগছিলো আমার কাছে। নদীর এক পাশে বিস্তীর্ণ বালুচর, অন্য পাশে সবুজ পাহাড়ের হাতছানি।
একদা এই যাদুকাটা নদীতীরেই ছিল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী। এখন রাজ্য নেই, নেই রাজধানীও। তবে যাদুকাটা নদীর উৎসমুখ, নদীর চারপাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবশ্যই মুগ্ধ হওয়ার মতো। এলাকার নামের সঙ্গে রাজ্যের নামটিও জড়িয়ে আছে, ‘লাউরেরগড়’।
যা দেখছি-২
শিমুল বাগান। যাদুকাটা নদীর তীর ঘেঁষে লাউড়েরগড় এলাকায় বিস্তীর্ণ এক নান্দনিক সৌন্দর্যের নাম শিমুল বাগান। বসন্তে শিমুলের রক্তরাঙা সৌন্দর্য দেখতে দূর্গমপথ পাড়ি দিয়ে পর্যটকরা হাজির হন এই লাউড়েরগড়ে। ধূসর ঘাসে মেলে থাকা শিমুলের রক্তিম আভা মন রাঙায় তো বটেই, ঘুম ভাঙায় সৌখিন হৃদয়েরও।
২০০২ সালে বাণিজ্যিক এই শিমুলের বাগান গড়ে তোলেন বাদাঘাট (উত্তর) ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তার পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান।বাগানের বিশালতা অবাক করার মতো। প্রায় ২ হাজার ৪০০ শতক জমি নিয়ে এই শিমুল বাগান। গাছগুলোও লাগানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে।
যেকোনো দিক থেকে তাকালে গাছগুলোর একটা মিল পাওয়া যায়। ফাগুনের শুরুতেই হাজার দু’য়েক গাছে যখন একই সাথে ফুল ফোটে তখন অসাধারণ এক দৃশ্যের অবতারণা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। মধু আহরণের টানে ছুটে আসে হরেক রকমের পাখপাখালি।
যদিও এখন বসন্ত নেই; গাছে গাছে ফুল নেই, তবু নিঃষ্প্রাণ মনে হয়নি বাগানটিকে। সারি সারি গাছের দৃশ্য, সবুজের সমারোহ, নতুন নতুন পর্যটকদের অানাগোনা আপনার মনকে কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও আচ্ছন্ন করে রাখবে। বাগানে বেশ কয়েকটি ঘোড়া আছে পর্যটকদের অানন্দ দেওয়ার জন্য। চাইলে সেগুলো চড়ে বাগানের ভেতর ঘুরাঘুরি করা যায়। আমরাও করেছি।
যা দেখছি-৩
বারেক টিলা। ৩০৫ একর জায়গাব্যাপী এই টিলার এরিয়া। তবে টিলার সব জায়গায়ই পর্যটনের উপযোগী নয়। এটিও তাহিরপুর উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত। টিলার উপর থেকে মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় দেখা যায়। বারিক টিলায় বেশকিছু আদিবাসী পরিবার বাস করে। সবুজে পরিপূর্ণ টিলার মধ্য দিয়ে টেকেরঘাট যাবার রাস্তা নির্মিত হয়েছে। বারেক টিলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভারতের খাসিয়া পাহাড় থেকে আসা যাদুকাটা নদী। আব্দুল্লাহ মাহমুদ ভাই জানালেন, বর্ষায় যাদুকাটা নদী বেয়ে ভারত হতে বাংলাদেশে প্রচুর বালু ও পাথর আসে। তখন এখানে বালু ও পাথর তোলার কর্মব্যস্ততা বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। বারেক টিলার উপর থেকে যাদুকাটা নদীর দিকে তাকালে যে নৈস্বর্গিক দৃশ্য চোখে পড়ে তার রেশ নাগরিক জীবনের ক্লান্তি নিমিষেই মুছে ফেলার জন্য যথেষ্ট। একপাশে বারেক টিলার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য, আরেক পাশে লাল ফুলের বাগান, মাঝে যাদুকাটা নদী, ওপারে মেঘালয় পাহাড় যেন প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য।
যা দেখছি-৪
নীলাদ্রি। এটাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নীল পানির খেলা সত্যিই অসাধারণ। এই জায়গাটি বহু আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। মূল নাম শহীদ সিরাজ লেক। তবে “নীলাদ্রি লেক” নামে অধিক পরিচিত। ভারতের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা একটি হ্রদ।
চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের পরিত্যক্ত এই খোয়ারীটি ১৯৪০ সালে চুনাপাথর সংগ্রহ শুরু করে। এখানে চুনাপাথর সংগ্রহ করে ছাতক উপজেলায় নির্মিত আসাম বাংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটানো হত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বিভিন্ন সমস্যা ও ব্যয় বৃদ্ধি দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এর সকল কার্যক্রম।
পরে ১৯৬০ সালে সিমেন্ট ফ্যাক্টরী চালু রাখার জন্য চুনা পাথরের প্রয়োজনে ভূমি জরিপ চালিয়ে সীমান্তবর্তী ট্যাকেরঘাট এলাকায় ৩২৭ একর জায়গায় চুনাপাথরের সন্ধান পায় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালে খনিজ পাথর প্রকল্পটি মাইনিংয়ের মাধ্যমে র্দীঘদিন পাথর উত্তোলন করা হয়। ১৯৯৬ সালে এই প্রকল্পটি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খোয়ারী থেকে চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। পুরনো অনেক মূল্যবান জিনিসপাতি এখানে-সেখানে এখনো পড়ে আছে। যা কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এগুলোর অনেকটা চুরিও হয়ে গেছে।
ওখানকার একজন বললো, এই লেকের কোনো কোনো জায়গার গভীরতা নাকি দুই-তিনশো ফুট পর্যন্ত আছে। এখানে পড়ে অনেক মানুষ মারা গেছেন! এমনকি কিছুদিন আগেও নতুন পর্যটকরা দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। সাঁতার না জেনে, জেকেট না পরে এখানে নৌকায় ওঠা বা পানিতে নামা অনুচিত।
যা দেখছি-৫
শাহ আরেফিনের মাজার। আসলে এখানে দেখার মতো কিছু নাই। এমনকি শাহ আরেফিনের মাজারও এখানে নেই। এই মাজারের নামডাক অনেক। সারা দেশ থেকে এখানে মাজারপূজারী মানুষরা ছুটে আসে। আমি ছোটবেলা থেকে এই মাজারের নাম শোনে আসছি। সেই কৌতূহল থেকেই এখানে যাওয়া। মাজারের খাদিমদের সাথে আমরা কিছু কথাবার্তা বললাম, মাজারের ইতিহাস জানতে চাইলাম। তারা নিজেরাও স্বীকার করেছেন যে, এখানে কোনো মাজার নেই। মাজার ছিল মূলত ভারতের অংশে। দু দেশের মাঝখানে বেড়া হয়ে যাওয়ায় সেখানে আর যাওয়া যায় না। আমরা জানতে চাইলাম তাহলে আপনারা “শাহ আরেফিনের মাজার” লিখে রাখছেন কেন? তারা বললো, উনি তো জিন্দা ওলি! ওনারা তো কখনো মারা যান না!! আর ওনি এখানে এসে ইবাদত করতেন তাই। দেখলাম ওরা ভণ্ডামি কথাবার্তা শুরু করে দিছে, তাই চলে আসতে চাইলাম। আসার সময় খাদিম বললো, যেহেতু বাবার মাজারে আসছেন তাই কিছু দিয়া যান, যা-ই পারেন শরিক হোন! ততক্ষণে আমাদের গাড়ি স্ট্যার্ট হয়ে গেছে!!
যা দেখছি-৬
হাওর বিলাস। আমরা ভাবছিলাম সময়ে হয়তো কুলাবে না। তাই এটা দেখার আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু হা. সাজ্জাদ ভাই প্যাঁচালি রাস্তা দিয়া উড়াল গতিতে আমাদেরকে নিয়ে আসলেন এখানে। আসার একমুহূর্ত আগেও বলেন নাই আমরা কোথায় যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি হাওর বিলাসের সামনে! সারপ্রাইজটা আসলেই দারুণ ছিলো। সূর্য ডুবে ডুবে অবস্থায় আমরা এখানে এসে পৌঁছি। বিশ্বম্ভপুর উপজেলা পরিষদের একেবারে সম্মুখে করচার হাওরের পরিবেশ উপভোগ করার জন্য পানির উপরে তৈরি করা হয়েছে হাওর বিলাস। সাদা রংয়ের দৃষ্টিনন্দন কাঠের তৈরি কয়েকটি বেঞ্চ রাখা হয়েছে পর্যটকদের বসার জন্য। পাশেই আছে পর্যটকদের হালকা খাবারের সাদা রংয়ের একটি দোকান। স্পট ছোট কিন্তু খুবই সুন্দর। মানুষের আনাগোনা প্রচুর। বিশম্ভপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসারকে তাঁর সৃজনশীল কাজের জন্য মন থেকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হলো। হাওর বিলাস, পাহাড় বিলাস, বোয়াল চত্ত্বর, পলাশ বাজার ইত্যাদি তাঁর সৃজনশীল মানসিকতার প্রমাণ। হাতে সময় কম থাকায় আমরা এখানে বেশি দেরি করিনি।
বিদায়
মাগরিবের নামাজ পড়লাম পলাশ বাজারে এসে। নামাজে মুসল্লিদের উপস্থিতি দেখে আনন্দ লাগলো। আঞ্চলিক মসজিদগুলোতে এত মুসল্লি কমই দেখা যায়। ইমাম সাহেবের তেলাওয়াতটাও মাশাআল্লাহ হৃদয়কাড়া। প্রশান্তচিত্তে নামাজটা পড়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। নামাজের পর এই মসজিদের সাবেক ইমাম মাওলানা শহিদুল ইসলাম পলাশী ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। এবার তিনি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে আসছেন। ভাইয়ের নির্বাচনী আলাপ-আলোচনা শোনলাম। অতঃপর চা-বিস্কুট খেয়েই বিদায় নিলাম।
অনুভূতি-১
আমাদের বেড়ানোর দিনটা ছিল রৌদ্রময়। রৌদ্রে প্রখরতাও ছিল। কিন্তু আমাদের তেমন একটা অশস্তি লাগেনি, ক্লান্তিও লাগেনি। জানি না প্রিয় বন্ধুদের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে! তবে মজা হয়েছে অনেক। বেড়ানো হয়েছে ইচ্ছে মতো। কোনো পিছুটান ছিল না, তাড়াহুড়ো ছিল না। এ স্মৃতি মনে থাকবে অনেকদিন ইনশাআল্লাহ।
অশেষ কৃতজ্ঞতা বন্ধু হা. সাজ্জাদের প্রতি। কারণ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর স্পেশাল ড্রাইভিং ছাড়া আমাদের জন্য একদিনে এত জায়গা বেড়ানো অসম্ভব ছিল। আর বন্ধুবর আব্দুল্লাহ মাহমুদের কথা কী বলবো, মানুষটা দেখতে যেমন সুন্দর তাঁর সাথে সময় কাটানো আরো সুন্দর। বৈঠক বলেন আর ভ্রমণ বলেন সেটাকে দারুণভাবে উপভোগ্য করার জন্য তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আজকের ঘোরাঘুরিটা হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই।
অনুভূতি-২
এক একটা পর্যটন স্পটে জড়িয়ে আছে বহু মানুষের রুটি-রুজির ব্যাপার-স্যাপার। কেউ পান, কেউ পানি, কেউ ফুল, কেউ চানাচুর , কেউ শরবত, কেউ টিকেট নিয়ে বসে আছে। আবার
কেউ ঘোড়ায় ছড়িয়ে, কেউ ছবি তুলে টাকা ইনকাম করছে। আরো কতজন কতো ফন্দিফিকির করে এখানে আয়-রোজগারের চেষ্টা করছে। এদিকটাও ভাবার বিষয়।
শেষ ম্যাজিক!
দেশের নানাপ্রান্ত থেকে মানুষ ছোটে আসে এসব জায়গা দেখার জন্য। সবসময় কমবেশি পর্যটকরা আসা-যাওয়া করছেই। নিজের মতো করে একটু সুখ-অানন্দ খুঁজে নিচ্ছে সবাই। প্রশান্ত করছে নিজের চোখ ও মনকে। আমরাও গেলাম- আসলাম। কিছুটা হলেও ভালো লাগছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষদের এসবে তেমন একটা আগ্রহ নেই! তারা বলে, মাঠি-পানি ছাড়া এখানে দেখার আর কী আছে?!