বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪২ অপরাহ্ন
ফয়সাল আহমেদ ফুয়াদ ::
বিশাল সমুদ্রে যেন মিশেছে দূর আকাশের সীমানা। উত্তাল সমুদ্রে ঢেউয়ের পেছনে ফণা তুলে আসে ঢেউ। সাথে দুধ সাদা ফেনার উৎসব। বিরামহীন ঢেউয়ের নৃত্যে ঝংকার তুলে হুহু সুরের মূর্ছনা । সৈকতে আছড়ে পড়া সে ঢেউ পর্যটকদের পায়ে পরায় ফেনার নূপুর । সমূদ্রের মনভোলানো নানান রোমাঞ্চ মুহূর্তে ভুলিয়ে দেয় পর্যটকদের সব ক্লান্তি। শিস দিয়ে যেন আনাড়ি করে তুলে পর্যটকের মন। তাইতো দিন গড়াতেই তার বুকে জমে পর্যটকের উপচে পড়া ভীড়। বলছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এবং বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন স্পট এটি।
কক্সবাজার বেড়ানোর ইচ্ছা বহুদিনের। প্রিয় সেলিম স্যার, মুমিন স্যার, মামুন ভাই, আর শরিফ ভাইয়ের সাপোর্টে বেরিয়ে পড়ি ইচ্ছে পূরণে। সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলা থেকে সেদিন (২৩ অক্টোবর ২০১৯) সন্ধ্যায় আমাদের বাস ছাড়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে অভিমুখে। সন্ধ্যা গড়িয়ে পৃথিবীর বুকে নামে নিকোশ কালো অন্ধকার। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে আমরা পৌঁছোয় রেল স্টেশনে। রাত ৮ঃ৪৫ মিনিটে ট্রেন ছাড়ে।
চোখেমুখে তখন কক্সবাজার ভ্রমণের তীব্র উত্তেজনা। সমান উত্তেজনা আমার পাশে বসা শরিফ ভাই ও আজিজুল আমাদের ট্যুরের সবার চোখে। তাইতো নানা গল্পে মেতেছি আমরা সবাই। কিছুদূর যেতেই যেন গহিন ঘুমে ডুব দিলেন আরফান ভাই। ট্রেনে কারো চোখে ঘুমের আবেশ কারোবা চোখে কক্সবাজার যাওয়ার উত্তেজনায় ঘুম নিরুদ্দেশ । সরি বলতে ভুলে গেছিলাম। রাতের খাওয়াদাওয়া পর্ব আমরা সিলেট পানসীতে করেছিলাম।
অন্ধাকারের ফ্রেমে আবদ্ধ দৃষ্টি। তাইতো দেখা যায়না দূর সীমানা। মাঝে মাঝে রাতে ট্রেনে হিজরাদের হামলা, সবাই তখন গ্রুপে বলে হিজরা আসতেছে সবাই সচেতন হয়ে যাও। মুমিন স্যারকে বলেয় ফেলছে এ দাদা উঠনা টাকা দেনা। মুমিন স্যার বিপদে পরে তার বিশ টাকা উদাও। যাই হোক চলতে চলতে রাতের খোলস ফুড়ে উঁকি দেয় ভোর। চোখ ছুঁয়ে যায় আলোর আলপিন।
ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করতে মাঝে মাঝে ব্রেক কষে ট্রেন। সকাল সকাল চট্টগ্রাম পৌঁছোয় ট্রেন। কড়া লিকারের চায়ে চলে মন চঙ্গা কারার আয়োজন। কখনো ভুরিভোজ । তার পর আবার বাসে উঠলাম অবশ্য কর্ণফুলী সেতুর কাছে এসে মন যেন বলছে এইতো চলে আসছি কক্সবাজারে কিন্তু বাসতো থামেনি আমাদের । বাংলাদেশের অন্যতম এ দীর্ঘ সেতুকে ঘিরে জমে উঠেছে সকালের ব্যাস্ত নদী বন্দর । বন্দরে জাহাজ, মাছধরা ট্রলার আর সাম্পানের যেন মিলন মেলা, জেলেরা ঝাকে ঝাকে মাছ তুলছে পাড়ে । ইলিশের ঘ্রাণ যেন পাগল করে মন । এমন পরিস্তিতে কিছু সময় না দাড়িয়ে এবং মাছ আহরোনের এ দৃশ্য উপভোগ না করে গাড়িতো আর সামনে এগুতে দেয়া যায়না। যাই হোক সময় সল্পতার কারনে আমাদের বাস আর থামেনি। সড়কের ছন্দে চলে গাড়ি। কোথাও চোখের সামনে ধরা দেয় ছায়া ঘেরা গাছের সারী, নদী, হাওর, ঘনজঙ্গল, পাহাড় কখনোবা শহরের অট্রালিকা । জানালা দিয়ে কখনো দৃষ্টি চলে যায় দৃর সীমানায় ।
পাহাড়, নদী, ঘনজঙ্গল, শহরের কোলাহল আর খোলা প্রান্তরের প্রদর্শনী উপভোগ করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের গাড়ি থামে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্র পাড়ে। কলাতলি বিচ স্টেন্ডে গাড়ি পার্কিং করে টানা ভ্রমণ থেকে মিলে নিস্তার।
একটানা ভ্রমনের ক্লান্তি ভর করেছে সবার উপর। তাই চোখ কচলাতে কচলাতে বিশ্রামের জন্য হোটেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সবাই। মোটামোটি সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আমাদের কয়কেজনের চোখে কিছুতেই ঘুম আসছেনা। কেননা স্টেন্ড থেকে সমুদ্রের যে গর্জন শোনা গিয়েছিল সে গর্জন কানে ভাসছে বারবার। তাই কিছু সময় বিস্রাম নিয়ে ছুটে চলি সমুদ্র পানে। নগ্ন পায়ে সৈকতের নরম বালুচরে দাঁড়াতেই সমস্ত ক্লান্তি যেন মুহূর্তে ধুয়ে নিয়ে যায় সমূদ্রের উচ্ছ্বাস। রাতের সমূদ্র একেবারে অন্যরকম। ব্যস্ত নগরীর ক্লান্ত নাগরীকের নাক ডাকা সুরে যেন ঘুমিয়ে যায় পুরো পৃথিবী। কিন্তু সদা জাগ্রত সমূদ্রের উত্থাল ঢেউয়ে যেন উতলা করে তুলে আমাদের মন । এ দৃশ্য অসাধারন । রাতকে বিদায় দিতে সমূদ্র বুকে জোয়ার এসে যেন চলে ভোরের আমন্ত্রণ। আকাশে আলো ফোঁটলে চোখে ধরা দেয় বালুচরে লাল কাঁকড়ার লুকুচুরি খেলা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া নানা রঙ্গের শামুক-ঝিনুক।
সকালে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামে চলে যাই। চোখে ঘুমের হাল্কা পরশ এলেও যেন জেগে থাকে মন। সকাল আটটা বাজতেই গোসলের প্রস্তুতি সেরে ছুটে চলি সমুদ্র-রোমঞ্চে । ঢেউয়ে পিঠ ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে পড়া, ঢেউয়ে ভেসে কিংবা লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দেওয়ার সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। যেন ফিরে যাই শৈশবে। ঢেউয়ের সাথে চলে অবিরাম ছেলেখেলা। চলে ওয়াটার বাইক, মোটর বাইক, সার্ফিংয়ের এডভেঞ্চার । ছাতার নিচে বসে এ দৃশ্য উপভোগের স্বাদ একেবারে ভিন্ন। বিচে ছাতায় বসে, পাড়ে দাড়িয়ে কিংবা সমুদ্র ঢেউয়ে ভিজে জুবুথুবু হয়ে চলে ক্লিক ক্লিক ছবি তোলার ধুম। ভ্রমণের এ সেরা সময়টুকু হয় ক্যামেরাবন্দি। কলাতলি, সুগন্ধা, লাবনী বিচ সহ আরো কয়টি বিচ, ঢেউ আর গর্জন মিলে সমুদ্র সাজিয়ে বসেছে রোমাঞ্চিত সৌন্দর্যের পসরা। এ যেন মনোমুগ্ধকর এক ভিন্ন জগত।
শেষ বিকেলে আসে জোয়ার, পৃথিবীর বুকটাকে লালা রঙ্গে সাজিয়ে লাল থালার মতো সূূর্য ঢুবে পশ্চিম সমুদ্রে । দিনের ক্লান্তিতে বিদায় হয় ঢেউয়ের সাথে পাঞ্জা লড়ার রোমাঞ্চ।
সূর্যাস্তে এ যেন সমূদ্রের সাথে গভির প্রেম ।
সেন্টমার্টিন আর মহেশ খালির কথা আলাদা ভাবেই বলতে হয়। কম্পিউটারে বা পর্দায় আমরা যে সব ওয়ালপেপার দেখি তা যদি বাস্তবে দেখতে চান তাহলে চলে আসুন সেন্টমার্টিন। নারকেল জিন্জিরা বলা হয়ে তাকে। কেউ যদি আমাকে নির্বাসনে পাঠায় তাহলে আমার একটাই অনুরোধ থাকবে যেন সেটা সেন্টমার্টিন হয়। যদিও আমরা সেন্টমার্টিন যেতে পারিনি। তবে শুনেছি এতটাই মুগ্ধকর পরিবেশ।
গানে বলা হয়েছিল-
যদি সুন্দর একটা মন পাইতাম
মহেশখালির পান খিলি তারে বানাইয়ে খাওয়াইতাম।
কথা গুলো যে এমনি বলা হয় নি তা বুঝতে পেরেছি মহেশখালির মিষ্টি পান খেয়ে। জীবনের প্রথম পান খাওয়া শুরু করলাম আমি এই মহেশখালির পান দিয়ে। বিশাল সব মাঝ ধরার যান আর মানুষের অতিথি পরায়নায় মুগ্ধ হয়ে আমরা। এই সুন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। একে ছবিতেও বুঝানো যায় না। একে মনরে ভিতর পুষে রাখতে হয় সযতনে।
যখন আমরা হিমছড়ি পাহাড় থেকে উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকাই মনে হয় যেন আকাশে উড়ে উড়ে জল রাশি খেলা করছে আর সামনে শুধু ছবির মত আঁকা কিছু নড়াচড়া শুরু করেছে।
এক সময় হিমছড়িতে অনেক বড় বড় ঝরনা ছিল কিন্তু এখন শুধু তার অস্তিত্ব আছে নেই সেই ঢাল।
ইনানী বিচ এর কথাতো ভুলেয় গিয়েছিলাম। সাগর পার আর পাহাড় গেসে জাউবনের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এ যেন এক কাল্পনিক রাস্তা। যখন চান্দের গাড়ি দিয়ে যাই সাগরের ঢেউ গুলোর শব্দ কানে এসে লাগে আহা কি মনোরম দৃশ্য।
সৈকতে আমাদের বিনোদনের জন্য অনেক আয়োজন করে। পানিতে ঝাপাঝাপি করার ইচ্ছে আরো বাড়িয়ে দেয় । স্পিডবোডে গভীর সমুদ্রে যেতে এতো ভালো লাগে এ যেন এক সুখের পরশ। তপ্ত রোদে বালুকাবেলায় আয়েশ করতে আর ভিজে পায়ে জুতো হাতে নিয়ে হাটতে আরো বেশি ভালো লাগে। ডাবের পানি খেয়ে পেট ভরে যায় কিন্তু পানি ফুরায়না!
প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে কল্পনার সাগরে ডুব দিতে হবে না! এখানেই ডুব দিতে পারবেন।
এই সুন্দরে মুগ্ধ আমি করছি বয়ান এসে-
একবার হলেও যেও তুমি সুন্দরের এই দেশে।
কাটবে দিন কাটবে রাত চাদেঁর আলো আর সাগর পাড়
তপ্ত রোদে ডাবের পানি পান করে করবে তুমি সময় পার।